তিন কোটি চাকরি সমাচার

ফাইল ছবি।
ফাইল ছবি।

১৩ জুন বর্তমান মেয়াদের সরকার তাদের প্রথম বাজেট পেশ করেছে। আজ-কালের মধ্যে সেটি পাস হবে। বাজেটের তারুণ্য অংশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উল্লেখ আমাকে আনন্দিত করেছে। অর্থমন্ত্রী একটি সম্পূর্ণ অনুচ্ছেদ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য এবং একটি অনুচ্ছেদ উদ্ভাবনের জন্য আলাদা করে লিখেছেন। আমাদের স্নাতকোত্তীর্ণ উদ্দাম তরুণদের প্রায় ৪৭ শতাংশই কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারে না। কাজেই অর্থমন্ত্রী যখন বলেন, আগামী ১১ বছরে ৩ কোটি কর্মসংস্থান হবে, তখন আশায় বুক বাঁধি। কিন্তু সেদিন বাজেটে তারুণ্যের চাওয়া-পাওয়াসংক্রান্ত এক বৈঠকে এক বিপণন বিশেষজ্ঞ বন্ধু বললেন, এ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে প্রতিদিন গড়ে ১১ হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।

বোঝাই যাচ্ছে, প্রচলিত পদ্ধতিতে এই সমীকরণ মেলানো কঠিন। কারণ, একা সরকারের পক্ষে এত কর্মের সংস্থান করা সম্ভব নয়। এখনো তা হয় না। কারণ, কর্মবাজারের ৯০ শতাংশই বেসরকারি খাতের। বেসরকারি খাত কেমন করে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করে? যদি সেখানে নতুন বিনিয়োগের পরিবেশ থাকে, ব্যবসা করাটা সহজ হয়। কেন জানি বাজেটে এর পক্ষে তেমন জোরালো আশাবাদ নেই।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে তরুণদের কর্মসংস্থানের দুটি বড় খাত হয়েছে ই-কমার্স ও রাইড শেয়ারিং। এ দেশে ই-কমার্সের ব্যাপ্তি ও বিকাশ খুব বেশি হবে, এটা ভাবা ঠিক হবে না। কিন্তু এরই মধ্যে গুটি গুটি পায়ে এই খাতে প্রায় দুই লাখ লোক সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। ই-কমার্সকে কেন্দ্র করে টাকা লেনদেন, মালামাল পৌঁছে দেওয়ার কুরিয়ার সার্ভিস, ওয়েবসাইট সচল রাখার সেবা কিংবা অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রতিষ্ঠান—সব মিলিয়ে এই কর্মযজ্ঞ। এই যুক্ত তরুণদের বড় অংশই স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। তাঁদের অনেকেই নারী, যাঁরা আগে বাসায় অলস সময় কাটাতেন। ভ্যাটমুক্ত ই-কমার্স খাতে এবার কেন ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। এটি বিকাশমান এই খাতের সহায়ক হবে না। শুধু তা-ই নয়, এই খাতের অনেক উদ্যোক্তাই এত ক্ষুদ্র যে তাঁদের আয় করযোগ্য আয়ের সীমার নিচেই থাকে। ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময় উৎসে কর কর্তনের হার ৬ গুণ বাড়িয়ে আগের ৫০০ টাকার জায়গায় ৩ হাজার টাকা করা হয়েছ। একেবারে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, যাঁদের অনেকে নারী এবং যাঁদের আয় করযোগ্য নয়, তাঁদের জন্য এটি নেহাত একটি নতুন চাপ তৈরি করবে।

কিংবা রাইড শেয়ারিং উদ্যোগের কথা ধরা যাক। দেশীয় ‘সহজ’, ‘পাঠাও’ বা বিদেশি ‘উবার’–এর মতো অ্যাপগুলোর কল্যাণে লক্ষাধিক তরুণ-তরুণী নিজেদের কাজের একটা ক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছেন। হাজার তরুণের কথা জানি, যাঁরা মোটরসাইকেল বা গাড়ির বন্দোবস্ত করে এখন সহজ বা পাঠাওতে এই সেবা দিচ্ছেন। বাজেটে রাইড শেয়ারিংয়ের ভাড়ার ওপর ভ্যাট প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে এটি শুধু কোম্পানির কমিশনের (ভাড়ার ২০-২৫ শতাংশ) ওপর ছিল। দ্বিতীয়ত, রাইডারদের আয়ের ওপর কর। বেশির ভাগ বাইকার মাসে যে আয় করেন, তা শেষ পর্যন্ত করযোগ্য হয় না।

বাজেটে নবীন উদ্যোক্তাদের (স্টার্টআপ) জন্য আলাদা করে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা বেজায় খুশির খবর। কিন্তু এই ১০০ কোটি টাকা যদি আগের ইক্যুইটি ও এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ফান্ডের কায়দায় সরকারিভাবে বিতরণ করা হয়, তাহলে আগের মতোই এটি ব্যর্থ হবে। এটি বরং বেসরকারি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করার কথা ভাবা যেতে পারে, যেমনটি ভারতে করা হয়েছে। তাঁদের জন্য ম্যাচিং ফান্ডের সুযোগ রাখলে বাজেট বরাদ্দের কমপক্ষে দ্বিগুণ ফান্ড আমাদের উদ্যোক্তারা পেতে পারেন।

আমাদের তরুণ উদ্যোক্তারা, যাঁরা দেশে প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপের সংস্কৃতি শুরু করেছেন, সেখানে কেবল আর্থিক বিনিয়োগই যথেষ্ট নয়। এর প্রমাণ পেয়েছি অতিসম্প্রতি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাওয়ের একসঙ্গে ৩০০ কর্মীর চাকরিচ্যুতি দেখে। এ দেশে একসঙ্গে এত সংখ্যক কর্মীর চাকরি চলে যাওয়া এত দিন শুধু তৈরি পোশাকশিল্পে দেখেছি। দেখেছি বলে লে-অফকে আমরা শুধু কায়িক শ্রমের বেলায় প্রযোজ্য বলে ধরে নিয়েছি। কিন্তু বিনিয়োগনির্ভর, হাই বার্ন আউট (বিনিয়োগের টাকা খরচ করে কোম্পানির আকার বড় করা) প্রতিষ্ঠানের বেলায় এ রকম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। প্রযুক্তিনির্ভর বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এটি নিয়মিত হয়ে থাকে।

বিনিয়োগের প্রবাহ কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা যদি পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট না হয় কিংবা ডালপালা বাড়ানোর কাজটা যদি যথাযথ না হয়, পাঠাওয়ের বেলায় হয়তো এই তিন কারণই ঘটেছে, যার একটি ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি। ৩০ বছরের কম বয়সী কয়েকজন তরুণ মিলে গত কয়েক বছরে ৮০০ কোটি টাকার এই কোম্পানি গড়ে তুলেছেন এবং প্রায় ৭০০ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছেন। কিন্তু আমরা কেউ তাঁদের দুর্বলতাগুলো দূর করার চেষ্টা করিনি। আজ যদি দেশীয় বিনিয়োগকারীরা তাঁদের পাশে থাকতেন, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনার জোরটাও তাঁদের বেশি হতো। শুধু তা-ই নয়, এই তরুণদের পাশে দাঁড়ানোর মতো অভিজ্ঞ ফিন্যান্সিয়াল ব্যবস্থাপক বা উপদেষ্টা জোগাড় করে দেওয়াও আমাদের উচিত ছিল। আমরা সেসবের কিছু না করে এখন তাঁদের চাপে ফেলার ব্যবস্থা করছি। কেউ কেউ আগবাড়িয়ে এমন সব নতুন তত্ত্ব হাজির করছি, যা শেষমেশ প্রযুক্তি খাতের বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের আমাদের ওপর আস্থা নষ্ট করে ফেলতে পারে।

৪০ বছর ধরে গড়ে ওঠা তৈরি পোশাকশিল্পের পাশে যদি সরকার এখনো বাড়তি তিন হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা নিয়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে আমাদের নতুন তরুণেরা, যাঁরা এশিয়ার সেরা উদ্যোগগুলোর মধ্যে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারেন, তাঁদের পাশে কেন আমরা দাঁড়াই না।

না দাঁড়ালে ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি কর্মসংস্থানের সমীকরণ মেলানো আমাদের জন্য সত্যিই খুব কঠিন হয়ে যাবে।

মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান