বাংলাদেশে আইএস সক্রিয়: রোহান গুনারত্নে

রোহান গুনারত্নে
রোহান গুনারত্নে
>

শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত অধ্যাপক রোহান গুনারত্নে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। গত বছরের ২ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে তাঁর মাউন্ট সিনাই লেনের বাসভবনে এবং গত সপ্তাহান্তে অনলাইনে আইএস, সন্ত্রাসবাদসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান। 

প্রথম আলো: হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আগে ও পরে আপনি নির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে বাংলাদেশে আইএস তার নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। ওই হামলার তিন বছর পর আপনার মূল্যায়ন কী?

রোহান গুনারত্নে: আইএস দ্রুত এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। এখানে বিশ্বের ৬৩ শতাংশ মুসলিমের বাস। এশীয় মুসলিমরা উদারনৈতিক এবং তারা সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি ভাবধারা এশীয় মুসলিম ঐতিহ্যকে প্রতিস্থাপন করছে। যেহেতু সমগ্র অঞ্চল আইএসের হুমকির আওতায় এসেছে, তাই এশীয় সরকারগুলো এবং তাদের অংশীদারদের উচিত হবে অতীতের চেয়ে বেশি জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আইএসের আদর্শ অবকাঠামোগতভাবে এবং অনলাইনে বিস্তৃত হচ্ছে। আইএসের হুমকি নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কঠোর পরিশ্রম করছে। তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন দিতে হবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে আইএসের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে যে দাবি আপনি করেছেন, সেটা আপনার গবেষণার ফল এবং আইএস সদস্যদের সাক্ষাৎকারও আপনি নিয়েছেন। কিন্তু সেগুলো কি আপনি কখনো বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন? আপনি কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জঙ্গিবাদ বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা করেন?

রহান গুনারত্নে: ২০১৫ সালের ২১ জুলাই বাংলাদেশে আইএসের কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী সারোয়ার জাহানের নেতৃত্বাধীন জেএমবির সঙ্গে হাত মেলান। তাঁরা উভয়ে তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের খলিফা আবু বকর আল-বাগদাদির অনুগত। তামিম চৌধুরীর সঙ্গে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। তিনিই বাংলাদেশে শিয়া, বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং বিদেশিদের হত্যার মতাদর্শের সূচনা করেন। তাঁরা নিজেদের গ্রুপ বিলুপ্তির ঘোষণা দেন এবং যৌথভাবে কাজ করার দলিলে সই করেন। সারোয়ার ও তামিম চৌধুরী এ জন্য মজলিশে শুরা বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন এবং তাঁদের মনোনীত শুরা সদস্যরাই হোলি আর্টিজানে হামলার অনুমোদন দেন।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে আইএস নেই—এই অবস্থান আজও বাংলাদেশ রক্ষা করে চলছে। আপনি কীভাবে দেখেন?

রোহান গুনারত্নে: এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার স্বীকার করেনি যে বাংলাদেশে আইএস কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু গোয়েন্দা অনুসন্ধান এবং উদ্‌ঘাটিত সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা সন্ত্রাস দমনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের কাছে স্পষ্ট যে আইএস সক্রিয় রয়েছে। তবে রাজনৈতিক নেতারা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে যদি বাংলাদেশের মাটিতে আইএস রয়েছে বলে স্বীকার করা হয়, তাহলে তা আতঙ্ক সৃষ্টি করবে। বিনিয়োগ ও পর্যটনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তঁাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে এবং বাংলাদেশ একটি ভূরাজনৈতিক রণক্ষেত্রে পরিণত হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যদি এটা জনগণের সামনে স্পষ্ট করত, তাহলে আইএসের নৃশংসতা বিবেচনায় আইএসকে বাংলাদেশের মাটি থেকে নির্মূলে আরও ব্যাপক মাত্রায় চাপ তৈরি হতো। জনগণও এ বিষয়ে সতর্ক ও সজাগ হতো। বাংলাদেশ যেহেতু এখনো আইএসের অস্তিত্ব অস্বীকার করে যাচ্ছে, তাই জনগণের মধ্যে সতর্ক থাকার বোধ তৈরি হয়নি। অথচ আইএস প্রতিরোধের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে যে আইএসের নেটওয়ার্ক রয়েছে, তা আপনি নিজে কতটা যাচাই করে দেখেছেন?

রোহান গুনারত্নে: আইএসের পদচিহ্নসহ বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের হুমকির বিষয়ে আমি সচেতন। গত ১৫ বছরে আইএস সদস্যসহ বাংলাদেশের বহু সন্ত্রাসীর সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি। বাংলাদেশ এবং বিদেশি সরকারগুলোর তৈরি করা শত শত প্রতিবেদন আমি পর্যালোচনা করেছি। এর মধ্যে পশ্চিমা একটি সরকারের করা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে তামিমকে আইএস নেতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বেকারিতে হামলার আগে এই প্রতিবেদন আমি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছিলাম। ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ও ৩ অক্টোবর দুটি ঘটনায় ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলা ঢাকায় এবং জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি রংপুরে নিহত হওয়ার পর এই দুজনকে হত্যার দায় আইএস স্বীকার করে। কিন্তু বাংলাদেশ তা নাকচ করে দেয়। হোলি আর্টিজানের আগে আইএস বাংলাদেশে ছয়টি হামলা পরিচালনা করেছিল। কিন্তু এরপরও কর্তৃপক্ষ তার নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সতর্ক করেনি যে আইএস বাংলাদেশের মাটিতে সক্রিয়ভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ভিন্নভাবে মোকাবিলা করলেই বেকারির হামলা প্রতিহত বা আগেই একটা পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হতো।

প্রথম আলো: শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলা এবং হোলি আর্টিজানের স্টাইলে কী মিল-অমিল দেখেন?

রোহান গুনারত্নে: শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ আইএসের হামলায় আক্রান্ত। উভয় ক্ষেত্রে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আইএসের উপস্থিতির বিষয়ে সতর্ক করেছিল। উভয় সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী সামর্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে থাকলেও তারা সন্ত্রাসী হামলা প্রতিহত করতে পারেনি কিংবা সন্ত্রাসীদের মূল নায়ককে নির্মূল বা গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় আইএস স্থানীয় ন্যাশনাল তৌহিদ জামায়াত এবং জমিয়াতুল মিল্লাতে ইব্রাহিম ফি সেলানি এবং বাংলাদেশে জেএমবির ওপর ভর করেছিল। হোলি আর্টিজান হামলা ছিল এশিয়ায় আইএসের তৎপরতার প্রাথমিক ইঙ্গিত। এশীয় নাজুক লক্ষ্যবস্তুর প্রতি আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে বিদেশি ও অমুসলিমদের হত্যায় তাদের প্রস্তুতির জানান দিয়েছিল তারা। দুর্ভাগ্যবশত শ্রীলঙ্কাসহ অনেক এশীয় দেশ হোলি আর্টিজানের হামলা থেকে পর্যাপ্ত শিক্ষা নেয়নি। অন্তত তিনটি পাঠ নেওয়া জরুরি। প্রথমত, হোটেল ও ক্যাফের মতো উন্মুক্ত স্থাপনার হুমকি; দ্বিতীয়ত, ট্যাকটিক্যাল টিম মোতায়েন করে হামলার আগেই দ্রুত সন্ত্রাসীদের স্তব্ধ করা। তৃতীয়ত, আইএসের কৌশল সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা, যার সারকথা হচ্ছে তারা কোনো সমঝোতা করবে না। তারা মারবে ও মরবে।

প্রথম আলো:সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এ এক প্রবন্ধে আপনি লিখেছেন, কলম্বোর এখন উচিত হবে সন্ত্রাসীদের সামর্থ্য এবং অপারেশন পরিচালনার কাঠামো ভেঙে দিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করা। এটা দক্ষিণ এশীয় অন্য সরকারগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কতটা? সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের বর্তমান সামর্থ্যকে কীভাবে দেখেন?

রোহান গুনারত্নে: আইএসকেন্দ্রিক হুমকিতে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সামরিক বাহিনী ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে কার্যকর সামর্থ্য অর্জন করেছে। তবে তিনটি দুর্বলতা রয়েছে, যেদিকে নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করি। প্রথমত, নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থীদের ডির‌্যাডিক্যালাইজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামর্থ্যের ঘাটতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, জঙ্গি হামলা প্রতিহত এবং জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণ ঠেকানোর কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ভালো ব্যবস্থাপনার অভাব। তৃতীয়ত, অনলাইনে উগ্রপন্থার বিস্তার প্রতিহত করতে যে মাত্রায় সামর্থ্য বাড়ানো প্রয়োজন, সেখানে ঘাটতি। এই দিকগুলোতে নজর দিতে হবে। আমি মনে করি, বাংলাদেশের উচিত হবে উগ্রপন্থী যেকোনো বক্তব্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং উগ্রপন্থায় বিশ্বাসী স্থানীয় ও বিদেশি প্রচারকদের নিয়ন্ত্রণ করা। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সেই মতাদর্শ, যা বাঙালি মুসলিমদের মহান ঐতিহ্যের অনিষ্ট করছে, তাকে ছড়াতে না দেওয়া।

প্রথম আলো: গত সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার সঙ্গে আলাপের সময় তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধ–পরবর্তী শ্রীলঙ্কায় তামিলদের সঙ্গে রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়া সন্তোষজনক। কলম্বো হামলার পর অনেকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারের আত্মতুষ্টিকে নিরাপত্তাঝুঁকি হিসেবে দেখছেন।

রোহান গুনারত্নে: সিংহলি, তামিল ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা বড় ভূমিকা রেখেছেন। তবে সম্প্রীতিকে কোনো সরকারেরই গ্যারান্টেড হিসেবে নেওয়া উচিত নয়। সব সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলমানদের সুরক্ষা দেওয়া এখন শ্রীলঙ্কার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা একটি আদর্শ সম্প্রদায়। আইএস দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় মুসলিম দ্বারা ইস্টার সানডের আক্রমণ সংঘটিত হলেও তা শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের বিশাল অর্জনকে খাটো করতে পারে না। মুসলমানরা আমাদের ভাই-বোন।

প্রথম আলো: আপনি বলছেন, আইএস প্রতিশোধস্পৃহা থেকে বিশ্বব্যাপী হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা কি খিলাফতের স্বপ্ন পরিত্যাগ করছে? তারা এখন জিহাদ রপ্তানি করবে?

রোহান গুনারত্নে: তাদের খিলাফতের স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। ইরাক ও সিরিয়ায় তার ভূখণ্ডগত নিয়ন্ত্রণ নেই। ১০ হাজারের বেশি যোদ্ধা নিয়ে তারা এখনো শক্তিশালী গ্রুপ। তাদের বৈশ্বিক অবকাঠামো আছে। উপরন্তু অনলাইনে বিরাট দক্ষতা অর্জন করেছে। সে কারণে আইএস ও আল-কায়েদা আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, জাতীয় এবং স্থানীয়ভাবে সরকার ও সমাজগুলোর প্রতি হুমকি বজায় রাখতে পারছে।

প্রথম আলো: কিন্তু সিরিয়ায় তারা ধসে পড়ছে, এখন তো তাদের সাংগঠনিক শক্তি নিস্তেজ।

রোহান গুনারত্নে: আইএস বিশ্বব্যাপী একটি সমর্থন ও অপারেশন অবকাঠামো সৃষ্টি করতে পেরেছে। ইরাক ও সিরিয়ায় শক্তি কমলেও তার নেতৃত্ব ও নেটওয়ার্ক মজবুত রয়েছে। বিশ্বব্যাপী হামলা চালাতে তারা সক্ষম। তাই তাদের পরাস্ত করতে সরকারগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে দরকার উত্তম বিকল্প মতাদর্শ উপস্থাপন করা, যার ভিত্তি হবে উদারনৈতিকতা, সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থান।

প্রথম আলো: আইএসের জঙ্গিরা কি তাদের নিজ দেশে ফিরে তৎপর হবে? বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে এই আশঙ্কা কতটা প্রাসঙ্গিক?

রোহান গুনারত্নে: আইএসের জন্য দক্ষিণ এশিয়া একটি অভয়াশ্রম। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যা। যদি এই জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ১ ভাগও যদি আইএস ভাবধারার ইসলামে উদ্বুদ্ধ হয়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়া ইরাক ও সিরিয়ায় পরিণত হবে। মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটান ছাড়া গোটা দক্ষিণ এশিয়া ইতিমধ্যে আইএসে আক্রান্ত হয়েছে। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার যে দক্ষিণ এশিয়ায় তারা আরও অধিকতর বিস্তৃতি ও গভীরতায় ছড়িয়ে পড়বে। তাই একে ঠেকাতে সরকারগুলোকে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।

প্রথম আলো: হোলি আর্টিজানে হামলার প্রেক্ষাপটে ঢাকায় আপনার শেষ বক্তৃতার পর আপনি নির্দিষ্টভাবে কোনো পুনর্মূল্যায়ন করেছেন কি?

রোহান গুনারত্নে: বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে তার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সামরিক বাহিনী ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে শুধু সহযোগিতামূলক সম্পর্ক নয়, বরং একসঙ্গে কাজ করার পরিস্থিতি তৈরি করা। প্রথমত, সরকারকে একটি অভিন্ন ডেটাবেইস প্রতিষ্ঠা করা উচিত। বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তারা ওই ডেটাবেইস ব্যবহার করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাস দমনে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে লোকবল বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর মাধ্যমে সেরা কৌশল ও শিক্ষণীয় বিষয়ের বিনিময় ঘটবে। তৃতীয়ত, সংস্থাগুলো যৌথভাবে প্রশিক্ষণ নেবে, আবার অপারেশনেও যাবে। চতুর্থত, তারা নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিনিময় করবে।

প্রথম আলো: একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হিসেবে বলুন বাংলাদেশ কীভাবে তার প্রধান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে?

রোহান গুনারত্নে: বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে একটি জয়েন্ট থ্রেট অ্যাসেসমেন্ট সেন্টার ও একটি জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটি প্রতিষ্ঠা করা। প্রতি সপ্তাহে ইন্টেলিজেন্স কমিটি তথ্য বিনিময়ে সভা করবে। আবার নিজেদের মধ্যে যথেষ্ট বিনিময় না করেই অভিন্ন টার্গেট সম্পর্কে তথ্য নেবে। আর জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নেতাদের সহায়তা দিতে সেন্টার সমন্বিত মূল্যায়ন রিপোর্ট দেবে।

প্রথম আলো: অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র অনেক সময় ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতো বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিছু মহল বাংলাদেশকে অযথা ভয়ংকর জায়গা হিসেবে দেখাতে চায়। অথচ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস সূচক অনুযায়ী ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বিপজ্জনক।

রোহান গুনারত্নে: উল্লিখিত দেশগুলোর যে কারও জারি করা নিরাপত্তা সতর্কতাকে গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে হবে। অবশ্য এর অপব্যবহারের উদাহরণও আছে। আমি ইমতিয়াজের সঙ্গে একমত। গত তিন দশক বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, দেশটি ভয়ংকর স্থান নয়। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও পর্যটন পূর্ণভাবে সমর্থিত হওয়া উচিত।

প্রথম আলো: জার্মান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. সিগফ্রিড উলফের মত হলো, হোলি আর্টিজানের তিন বছর পরও বাংলাদেশের নেতৃত্ব ও বিরোধী দল অনাগ্রহী কিংবা বুঝতে অক্ষম যে সংকীর্ণ রাজনৈতিক লাভের চেয়ে বৈশ্বিক জিহাদের পূর্ণমাত্রাকে উপেক্ষা করার মূল্য অনেক বেশি চড়া। এটা বাংলাদেশে মৌলবাদী চেতনার বিকাশকে আরও গভীরে নিতে পারে। মন্তব্য করুন।

রোহান গুনারত্নে: বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নেয়নি। প্রচলিত জঙ্গি দমন কর্মসূচির বাইরে উগ্রপন্থা নিরোধ এবং উদারীকরণ, সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের নীতি উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। সমকালীন সহিংসতা দমনে বাঙালির বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঋদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতিই শ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আপনি যদি একজন প্রকৃত বাংলাদেশি হন, তাহলে আপনি একজন সন্ত্রাসবাদী, উগ্রপন্থী হতে পারেন না। কিংবা এমনকি আপনি পারেন না কাউকে দূরে ঠেলে দিতেও।

প্রথম আলো: সেই ঘোর অমানিশার মধ্যেও একজন তরুণ আলো জ্বেলেছিলেন।

রোহান গুনারত্নে: ফারাজ হোসেনের ঘটনায় সবার মিলেমিশে একসঙ্গে থাকার প্রকৃত বাঙালি চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। জীবনে ও মরণে তিনি উগ্রপন্থা ও কাউকে বাদ দেওয়ার যে সন্ত্রাসী মতাদর্শ, তাকে নাকচ করেছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তাই ফারাজ তার বন্ধুদের পরিত্যাগ করেননি। ফারাজের উৎসর্গীকৃত জীবনের বার্তা হলো: সন্ত্রাসীরা কাপুরুষ, ফারাজ আমাদের নায়ক।

প্রথম আলো: গত ৩০ এপ্রিল ঢাকায় পুলিশের ওপর বোমা হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের মাধ্যমে ফের জানা গেল, এটা আইএস করেছে। মার্কিন এই ওয়েবসাইট নিয়ে অনেকের মধ্যে কৌতূহল রয়েছে।

রোহান গুনারত্নে: এই গ্রুপ আইএসের বৈশ্বিক আধিপত্য বিষয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও সংস্থা। বিশ্বে সরকারগুলোকে যথাসময়ে অনলাইনে গোয়েন্দা তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা পাঁচটি গবেষণা সংস্থার অন্যতম হলো সাইট ইন্টেলিজেন্স। তারা যখন বাংলাদেশে আইএস উপস্থিতি বিষয়ে বলল, বাংলাদেশি কর্মকর্তারা অবিশ্বাস করলেন। কারণ, তাতে তাঁদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং সাইটকে ঠাট্টা করতে বাংলাদেশিদের অনেকে তাকে বললেন ইহুদি সংস্থা। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব, আরব বিশ্ব যাতে সয়লাব, তা পরিহার করে বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের উচিত হবে সত্যে অবিচল থাকা। নিরাপত্তা হুমকি আগাম প্রতিরোধে বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম কমিউনিটির উচিত হবে জানাশোনা, পড়া ও গবেষণার পরিধি বাড়ানো, বিশ্বসেরা বিদ্যাপীঠে প্রশিক্ষণ নিয়ে সন্ত্রাস দমনে নিজেদের অভিজ্ঞ ঋদ্ধ করা।

প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা, তাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করার পরিণতিতে এই অঞ্চল এবং এর বাইরেও অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়তে পারে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা করেছেন।

রোহান গুনারত্নে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বেগ যথার্থ। সহাবস্থানের ব্যাপারে একটি বৈশ্বিক, আঞ্চলিক, জাতীয় অঙ্গীকার ছাড়া বিদ্যমান সংঘাতগুলো গভীরতর হবে এবং আরও নতুন নতুন সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হবে। ফিলিস্তিনি, কাশ্মীরি ও মরোদের মতো রোহিঙ্গা সংঘাত দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। অথচ এর একটি স্থায়ী সমাধানে কোনো আন্তর্জাতিক সদিচ্ছা নেই। মিয়ানমার ও বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা মুসলিমদের আরও বেশি কোণঠাসা হওয়া ঠেকাতে উভয় সরকারকে একত্রে কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গারা দীর্ঘ সময় ধরে উদ্বাস্তু শিবিরে আছে। শিবির পরিদর্শন করে আমার মনে হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনায় সমর্থন দেওয়া। উদ্বাস্তু অবস্থায় কয়েক দশক ধরে জীবন যাপন করার কারণে তাদের মধ্যে ঘৃণা ও সহিংসতার জন্ম দিতে পারে। আইএস যেভাবে বৈশ্বিক সম্প্রসারণ নীতি বাস্তবায়ন করছে, তাতে রোহিঙ্গাদের উগ্রপন্থায় সহজে আকৃষ্ট করা যাবে। আন্তসীমান্ত হুমকি প্রশমনে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের উচিত পরস্পরকে সহযোগিতা করা।

প্রথম আলো: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইএস ঢুকতে পারে, এমন কোনো আশঙ্কা জাতিসংঘ, দাতাগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় করছে বলে মনে করেন কি?

রোহান গুনারত্নে: মিয়ানমার ও বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই প্রতিশোধ বা পাল্টাপাল্টি হামলার নীতিতে বিশ্বাসী নয়। তারা অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রীতিতে বসবাস করতে আগ্রহী। তবে আল-কায়েদা ও আইএসকেন্দ্রিক গ্রুপগুলো ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গাদের উগ্রপন্থায় ভেড়ানোর চেষ্টা করেছে এবং রোহিঙ্গা নিয়োগে সীমিত সাফল্য পেয়েছে। অতীতে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, হারাকাতুক জিহাদি ইসলামি-আরাকান এবং সাম্প্রতিক কালে আরাকানে রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির উত্থান দেখা গেছে। যদিও এসব সংগঠনের প্রতি রোহিঙ্গাদের তেমন কোনো মাত্রায় সমর্থন নেই। তবে রোহিঙ্গাদের নিয়োগের বিষয়টিকে একটি ক্রমবর্ধমান ও সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখা চলে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেহেতু সম্প্রীতির সঙ্গেই বসবাস করতে চায়, তাই কোনো বিলম্ব ছাড়াই তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। রোহিঙ্গাদের উগ্রপন্থায় ঝুঁকে পড়া বা তাদের নিয়োগ কারও স্বার্থের অনুকূল হবে না। কারণ, সেই হুমকিটা সব দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

প্রথম আলো: রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন ও ভারতের শিথিল মনোভাবকে কীভাবে দেখেন, যদিও তাদের জানা যে ওই অঞ্চলে সম্ভাব্য ইসলামি জঙ্গিত্বের কোনো উত্থান দীর্ঘ মেয়াদে তাদের নিরাপত্তা স্বার্থকেই ব্যাহত করবে।

রোহান গুনারত্নে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত ও চীন—সব বড় শক্তিই মুসলিম হুমকি-গোষ্ঠী দ্বারা ভুগছে। চীন ও ভারত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর তরফে কোনো হুমকি আশা করে না, আবার একই সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের বাইরে গিয়ে মিয়ানমারকে তারা চটাতে চায় না। কারণ, বিষয়টি জটিল। আবার মিয়ানমারের ওপর প্রভাব বিস্তার করা নিয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। চীন বা ভারত—কেউ মিয়ানমারের ওপর তাদের খবরদারি হারাতে চায় না। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাটাই এ রকম যে সেখানে অপ্রথাগত নিরাপত্তা হুমকি ভূরাজনৈতিক স্বার্থের ওপর ঠাঁই পায় না।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

রোহান গুনারত্নে: ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎ​কারের পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি ভাষ্য পড়ুন: en.prothomalo.com