রেললাইনের নাটবল্টু ও প্রশাসনের নাটবল্টু

১৭৮৫ সালে ইংল্যান্ডে জেমস ওয়াট স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন। ১৮৩০ সালে লিভারপুল থেকে ম্যানচেস্টার পর্যন্ত যাত্রীবাহী রেলগাড়ি চালু হয়। তার পরের ৫০ বছরের মধ্যে এই বাষ্পীয় শকট ভারতবর্ষে আসে। ঔপনিবেশিক শাসকেরা তা চালু করেন তাঁদের অর্থনৈতিক স্বার্থে, কিন্তু উপকৃত হয় উপমহাদেশের মানুষও।

সাপ্তাহিক সম্বাদ প্রভাকর-এ পড়েছি, এই শকট চালু হওয়ার সময় প্রবল বাধা এসেছিল প্রাচীনপন্থীদের কাছ থেকে। তাঁদের বক্তব্য ছিল, এই গাড়ি চলে বিকট শব্দে, তাতে কানের বারোটা বাজবে। এই গাড়ির ঝাঁকুনিতে পুরুষ হারাবে পুরুষত্ব এবং মাথার ঘিলু যাবে নড়ে। শেষ পর্যন্ত প্রাচীনপন্থীদের পরাজয় হয়েছে।

এখন বাংলার মাটিতে প্রতিদিন রেলগাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মানুষ মরছে, প্রথম দিকে বোম্বে (মুম্বাই) থেকে যাত্রা শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছার আগেই ভয়ে হার্টফেল করে স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটেছে কারও কারও। এখন রেলগাড়িতে না চড়েই রেললাইনে মরছে, তখন গাড়ির কম্পার্টমেন্টে বসে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করত।

সারা পৃথিবীতে এখন রেলগাড়ি অন্যতম প্রধান গণযোগাযোগমাধ্যম। যেসব দেশে রেল যোগাযোগব্যবস্থা অতি উন্নত, সেখানেও রেলে দুর্ঘটনা ঘটে এবং বহু মানুষ হতাহত হয়। তবে ট্রেন চলাচলের ১৮৯ বছরের ইতিহাসে প্রথম ১০০ বছরে উপমহাদেশে রেললাইনে ট্রেনে কাটা পড়ে যত মানুষ মারা গেছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে তার চেয়ে কম মারা যায়নি। তার দায় পুরোটা রেল বিভাগের নয়। গত চার বছরে মনের সুখে রেললাইন দিয়ে হাঁটার সময় ট্রেনে কাটা পড়েছে আমার হিসাবে অন্তত ২৬ জন। তাদের অপমৃত্যুর জন্য ট্রেনের চালক এবং গার্ডকে কেউ দায়ী করবে না।

গত হপ্তায় কুলাউড়ায় রেলসেতু বিধ্বস্ত হয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় অনেক যাত্রী হতাহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু ও লাইন বর্ষার আগেই সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। রেলওয়ের একজন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী সব সময় থাকেন, এখনো আছেন এবং রেলপথ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর নয়, তা সত্ত্বেও রেলসেতু মেরামতের নির্দেশ তাঁকেই দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর অধীনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় রয়েছে। তার বাইরে তাঁকে সারা দেশের হাজারো সমস্যা নিয়ে ভাবতে হয়, অন্যান্য মন্ত্রণালয়েরও তদারক করতে হয়। রেলপথ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী, সচিব প্রভৃতি থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হবে কেন? তাঁদের কাজটা কী? কাজ তাঁদের আছে। সেটা দেখা গেছে কুলাউড়া দুর্ঘটনার পর—তার আগে নয়। বাংলাদেশে সবকিছুতেই ‘চমক’। উচ্চাসনে যাঁরা আসীন, তাঁদের কথাবার্তা শুনে কেউ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন আর কেউ হতাশায় নির্বাক হয়ে যান। কুলাউড়ার দুর্ঘটনার পর টেলিভিশনে যখন শোনা গেল রেলমন্ত্রী ব্যক্তি বলছেন, বেশি যাত্রীর কারণে দুর্ঘটনা, তখন মানুষের আর বলার কিছু রইল না। দোষটা গিয়ে পড়ল সরাসরি যাত্রীদের ঘাড়ে। তবে সেই সঙ্গে মানুষ এ কথাও ভাবল যে ট্রেনে এত যাত্রী, তা তো বিপুল লাভজনক না হয়েই পারে না।

রেল যোগাযোগসচিব একজন জনদরদি রাজনৈতিক নেতার মতো বলেছেন, ‘রেলপথ সংস্কার এবং যথাযথ মেরামত রাখা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরা যদি দায়িত্বে কোনো গাফিলতি করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি কারও দায়িত্বে অবহেলার জন্য লাইনচ্যুত কিংবা দুর্ঘটনা ঘটে, তাঁদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। লাইনের ত্রুটির জন্য দুর্ঘটনা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা আশা করছি, এমন পরিস্থিতি থাকবে না।’ [যুগান্তর, ২৯ জুন]

এই পরিস্থিতি হলো কেন, সে কথা তিনি বলেননি। তাঁর কড়া বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তাঁর দায়িত্ব পালনকালে রেলপথ মেরামতে কারও ‘গাফিলতি’ তিনি দেখতে পাননি। তাই যদি এখন কারও গাফিলতি দেখতে পান, তাঁর রেহাই নেই। আগে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, এবার তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না দায়িত্ব পালনে অবহেলা। ‘এমন পরিস্থিতি থাকবে না’ বলে তিনি অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। অতিশয় হিংসুটে ছাড়া এমন ভবিষ্যদ্বাণীতে কেউ সন্তুষ্ট না হয়েই পারে না।

রেলসচিব ওই সাক্ষাৎকারেই বলেছেন, ‘রেলপথে নাটবল্টু, ক্লিপ-হুক কিংবা ফিশপ্লেট কিছুতেই খোলা থাকতে পারে না। এটা নিশ্চয় সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়।’ যেসব জিনিস ঢিলা বা খোলা থাকতে পারে না, বাস্তবতা হলো তা রীতিমতো নড়বড়ে ও খোলাই আছে। তাঁর উদ্বেগে সন্দেহ পোষণ করার কোনো কারণই নেই, তবে কথায় যদি চিড়া ভিজত, তাহলে বাংলাদেশ রেলওয়ে এত দিনে জাপানকে ছাড়িয়ে যেত।

বাংলাদেশ রেলওয়ের দুর্দশার কিছু ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান রেলওয়ে বোর্ডের প্রধান কার্যালয় ছিল করাচি। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো রেলওয়েতেও পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নতি হয়েছে বেশি, পূর্ব পাকিস্তানে নয়। রেলওয়ের ওপর দ্বিতীয় আঘাত আসে স্বাধীনতার পর। বাঙালির কেরানিগিরিতে আগ্রহ বেশি, চেয়ার-টেবিলে বসে কলম পেশায় আনন্দ। শারীরিক শ্রমের প্রয়োজন হয় না। পাকিস্তান আমলে রেলওয়ের ওয়ার্কশপ ও কারিগরি বিভাগে ভারত থেকে আসা অবাঙালি মোহাজিররা কাজ নেন। বাঙালি মেকানিক ছিল খুব কম। স্বাধীনতার পর অবাঙালিদের অনুপস্থিতিতে রেলওয়ে সংকটে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর সরকার জরুরি ভিত্তিতে ভারত থেকে চালক, মেকানিক প্রভৃতি টেকনিক্যাল স্টাফ এনে রেলওয়েকে সচল করার ব্যবস্থা করে। ১৯৭২ সালে যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর সঙ্গে আমি সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, ঈশ্বরদী, চট্টগ্রাম প্রভৃতি রেলওয়ে ওয়ার্কশপে গিয়েছি। ভারতীয়দের সহযোগিতায় রেলওয়েকে স্বাভাবিক করতে এক-দেড় বছর সময় লাগে।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে রেলওয়ের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। অনেকগুলো স্থানীয় রেলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সড়কের ওপর জোর দিতে বলে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা। বর্তমানে ৩ হাজার ৩০০ কিলোমিটারের বেশি রেলপথের অবস্থা শোচনীয়। মোট ৩ হাজার ৬টি রেলসেতুর অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ ও নড়বড়ে। রেলসেতুগুলোর প্রায় সবই ব্রিটিশ আমলের। এগুলোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ নিম্নমানের।

আমরা যখন নাগরিকদের পক্ষ থেকে গণযোগাযোগ নিয়ে কথা বলি, তখন শুধু দুর্ঘটনা রোধের জন্য বলি না। আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থেই রেলওয়ে, সড়ক ও নৌপথের উন্নয়ন প্রয়োজন। রেললাইনের নাটবল্টু আপনা-আপনি খুলে যায়নি। দুর্নীতির ক্ল্যাসিক দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলওয়ের জমিগুলো পর্যন্ত বেহাত হয়ে যাচ্ছে। রেলমন্ত্রীদের কেউ স্ত্রীর কাছে নামমাত্র দামে রেলওয়ের জমি বেচে দিয়েছেন, কেউ ঘনিষ্ঠজনকে দিয়েছেন ইজারা।

বর্তমান সরকার রেলওয়েকে অত্যাধুনিক করতে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। অতিদ্রুতগতিসম্পন্ন বুলেট ও বৈদ্যুতিক ট্রেন যোগ হবে। কিন্তু পুরোনো রেলপথকে অবহেলিত রেখে, তাকে মেরামত ও সংস্কার না করে রেলওয়ের আধুনিকায়ন ফলপ্রসূ হবে না। বর্তমানে রেললাইনের অধিকাংশ জায়গায় ফিশপ্লেট, ক্লিপ, হুক, নাটবল্টু খোলা। স্লিপারগুলোর অবস্থা খারাপ। লাইনে প্রয়োজনীয় পাথর নেই। সেতুগুলোর সংস্কার নেই বহুকাল। সেতুর স্লিপারের আয়ু শেষ। রেলপথ পরিদর্শনের যথেষ্ট ওয়েম্যান নেই। নাটবল্টু, হুক, ফিশপ্লেট খসে পড়লেও দেখার কেউ নেই। কর্মকর্তাদের চোখ এখন মেগা প্রকল্পের দিকে।

বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ কবির কথাই সত্য: থিঙ্কস ফল অ্যাপার্ট, সেন্টার ক্যান নট হোল্ড। সবকিছু ভেঙে পড়লে রেললাইন ও রেলসেতু ভালো থাকতে পারে না। রেললাইনের নাটবল্টু, ক্লিপ, হুক ঢিলা হয়েছে পরে; তার আগে প্রশাসনের নাটবল্টু ঢিলা হয়েছে। প্রশাসন ও বিভিন্ন দপ্তরের নাটবল্টু টাইট দিলেই রেলপথ ও রেলসেতুর নাটবল্টু আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যাবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক