বিকৃত-বীভৎস অপরাধ কেন বাড়ছে

এক বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, তিনি খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। টিভি এখনো দেখেন, তবে শুধু ড্রামা সিরিয়াল আর খেলা। সংবাদ নয়। কারণ, তাঁর অভিযোগ, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ মানেই দুঃসংবাদ। কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই। মন খারাপ হয়ে যায়। রোজ সকালে দুঃসংবাদের মুখোমুখি হওয়া তাঁর কাছে ইদানীং অত্যন্ত পীড়াদায়ক মনে হয়।

‘বয়স হয়েছে, নার্ভের সেই শক্তি আর নাই, আর পারা যায় না।’

ভদ্রলোকের কথাগুলো শুনে মনে প্রশ্ন জেগে উঠল: আমরা যারা সংবাদমাধ্যমে কাজ করি, দুঃসংবাদ নিয়েই যাদের দিনরাত্রির কারবার, তাদের নার্ভের অবস্থা কী? প্লাস্টিক হয়ে গেছে?

সাধারণভাবে বললে, আমাদের স্নায়বিক সহ্যশক্তি অনেক বেড়েছে। নইলে প্রাত্যহিক বিভীষিকার সংবাদ সংগ্রহ করা, তারপর তা সাজিয়ে–গুছিয়ে পাঠক–দর্শকের সামনে পরিবেশন করার মতো শক্ত কাজ দিনের পর দিন চালিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। আমাদের খবরের ভোক্তা–সাধারণেরও নিশ্চয়ই বিভীষিকা হজম করার সামর্থ্য বেড়েছে। কিংবা উল্টো করে বললে, আমরা তাদের বিভীষিকা–দর্শনের নেশা ধরিয়ে দিয়েছি। নইলে কেন তারা সবচেয়ে বীভৎস অপরাধের খবরগুলোই সবচেয়ে বেশি ‘খায়’? অনলাইন সংবাদমাধ্যমে সর্বাধিকসংখ্যক ‘ক্লিক’ কেন সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর খবরগুলোর ভাগ্যেই জোটে?

সাংবাদিকতার আদি তত্ত্বে এ প্রশ্নের উত্তর আছে। কুকুর মানুষকে কামড়ালে তা কোনো খবর নয়, খবর হয় তখনই, যখন কোনো মানুষ কুকুরকে কামড়ায়। মানুষের এই কৌতূহলপ্রবণতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বলার কথাটা হলো, খুন–ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধগুলোও এখন আর আমাদের নাড়া দিতে পারছে না। আমরা নাড়া খাই তখন, যখন মানুষকে খুন করা হয়েছে অতিশয় বীভৎস পন্থায়। একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে—এটা এখন একেবারেই আটপৌরে, চাঞ্চল্যহীন খবর। চাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে তখন, যখন মেয়েটিকে দলবদ্ধভাবে উপর্যুপরি ধর্ষণ করার পর বীভৎসভাবে হত্যা করা হবে। ছিনতাইয়ের সব খবর আজ আর সংবাদমাধ্যমে জায়গাই পায় না; জায়গা পাবে যখন ছিনতাইকারীরা শুধু কিছু ছিনিয়ে নিয়েই সটকে পড়বে না, তাদের নিরীহ শিকারটির পেটে ছুরি মেরে ফেলে রেখে যাবে এবং সেই বেচারা রাস্তার ধারে পড়ে থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যাবে।

যা বলতে চাচ্ছি, তা সংক্ষেপে এই: বাংলাদেশে অপরাধপ্রবণতায় অহেতু অতিরিক্ত হিংস্রতা যুক্ত হয়েছে; কোনো কোনো অপরাধের ঘটনায় অপরাধীদের আচরণে মানসিক বিকৃতির লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অতিশয় হিংস্রতাপূর্ণ ও বীভৎস অপরাধের ঘন ঘন পুনরাবৃত্তির ফলে সামাজিক সংবেদ ক্রমেই কমে যাচ্ছে, সমাজ নির্বিকার হয়ে পড়ছে, ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। ব্যক্তির চেতনা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে শুধুই নিজের ও স্বজনের নিরাপত্তার তাগিদকে ঘিরে। এসব কোনোভাবেই সুস্থ–স্বাভাবিক সমাজের লক্ষণ নয়।

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এটা সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। তাত্ত্বিকভাবে অনেকেই অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু প্রশ্নটার নির্ভরযোগ্য উত্তর পেতে হলে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও শাসনব্যবস্থার পটভূমিতে বড় পরিসরে গবেষণার প্রয়োজন হবে। সে রকম কোনো গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমি সাধারণ কৌতূহল থেকে বিভিন্ন সময়ে ওয়াকিবহাল লোকজনের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলি।

যেমন গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে জয়পুরহাট সদর থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মমিনুল হকের সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে তাঁকে বলেছিলাম, আড়াই বছর বয়সী শিশু থেকে ৫৮ বছর বয়সী বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। আড়াই বছরের শিশু কীভাবে ধর্ষণ করা সম্ভব? আমার প্রশ্নের উত্তরে ওসি সাহেব বললেন, ‘শোনেন, যত রকমের উদ্ভট, অস্বাভাবিক ক্রাইম দেখবেন, সবগুলোর পেছনে আছে মাদক। একটি ছেলে যখন মাদক নেয়, তখন তার আর কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আড়াই বছরের একটি বাচ্চাকে যে রেপ করা সম্ভব নয়, এই সাধারণ বোধটাই সে হারিয়ে ফেলে। অন্য সব ক্রাইমের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার।’

অনেক থানায় দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার কাছে আমি একই ধরনের বক্তব্য শুনেছি। অপরাধপ্রবণতায় মাদকদ্রব্যের প্রভাব বুঝিয়ে বলার সময় এক ওসি আমাকে যা বলেছিলেন, তা এই রকম: ধরেন, কেউ মাদকাসক্ত অবস্থায় ঘরে ফিরে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করল। একপর্যায়ে সে বউকে মারতে শুরু করল, ক্রমেই সে হিতাহিত জ্ঞান হারাতে থাকবে। এই পরিস্থিতিতে বউটার খুন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি থাকে। অর্থাৎ মাদকদ্রব্যের প্রভাবে অপরাধকর্মে অতিরিক্ত হিংস্রতা যুক্ত হতে পারে।

বরগুনায় প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে যারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তারা মাদকসেবী ও মাদকের ব্যবসায়ী—এমন কথা সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারীরা অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন, ওই তরুণেরা যখন রিফাতকে ওভাবে কোপাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে তারা মাদক–প্রভাবিত ছিল কি না। যদি তারা মাদকদ্রব্য সেবনের পর ওই হত্যা অভিযানে নেমে থাকে, তাহলে এ রকম বীভৎস অপরাধপ্রবণতার পেছনে মাদকের প্রভাবের একটি সাক্ষ্য মিলতে পারে। সাতক্ষীরায় ছিনতাইকারীরা ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় সেটির চালক ১২ বছর বয়সী শাহীনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মাথার খুলি ভেঙে দিয়েছে, তাদের এমন হিংস্র আচরণের স্বাভাবিক কোনো যুক্তি–ব্যাখ্যা মেলে না। তারা মাদকাসক্ত ছিল কি না, এটাও একটি অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে।

অতিশয় হিংস্র ও বীভৎস অপরাধ সংঘটনের প্রবণতার সম্ভাব্য কারণগুলো সম্পর্কে জিগ্যেস করেছিলাম মনোরোগের চিকিৎসক আহমেদ হেলালকে। টেলিফোনে তিনি আমাকে বলেন, মাদকদ্রব্যের প্রভাব আছে, তবে তা বেশি গুরুত্ব পেলে অপরাধীর শাস্তি লঘু করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কারণ মাদকাসক্তি যতটা ব্যাধি হিসেবে গণ্য হয়, অপরাধ হিসেবে ততটা নয়। সে জন্য মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন বেশি গুরুত্ব পায়, শাস্তি নয়।

আহমেদ হেলাল বেশি গুরুত্ব দিতে চান ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, তার ওপর সামাজিক–সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক পরিবেশ–পরিস্থিতির প্রভাবের ওপর। যারা মানুষ খুন করার মধ্য দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, তাদের মধ্যে একধরনের ‘হিরোইজম’ কাজ করে। যারা নিজের শক্তি, সাহস, ক্ষমতা, আধিপত্য দেখিয়ে অন্যদের মনে ভয় ছড়াতে চায়, তারা যদি কাউকে খুন করে, তাহলে তা এমনভাবে করে যেন সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়া যায়, স্তম্ভিত করা যায়।

রিফাতের হত্যাকারীদের মধ্যে সম্ভবত এসব প্রবণতা কাজ করেছে। তারা রিফাতকে জনসমক্ষে পৈশাচিকভাবে খুন করার সাহস দেখাতে পেরেছে আরও একটা কারণে। সেটা হলো স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব। তারা তাদের প্রশ্রয় বা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে এবং সে কারণে তাদের মনে এই অভয় কাজ করেছে যে রিফাতকে খুন করে তাদের আইন ও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না। এর আগে অনেক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও তারা যেভাবে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, রিফাতকে খুন করার পরেও সেভাবেই বেরিয়ে আসতে পারবে।

ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় লালিত–পালিত অপরাধীদের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত (অলিখিতভাবে) ইমপিউনিটি (শাস্তির ভয় ব্যতিরেকে অপরাধ সংঘটনের সুযোগ) থেকে যে বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে মাদকদ্রব্যের অবাধ ব্যবহার যুক্ত হলে হরর সিনেমার মতো বীভৎস–বিভীষিকাময় অপরাধ সংঘটনের প্রবণতা বেড়ে যাওয়া মোটেই অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। মাঝেমধ্যে ব্যাপক জনপ্রতিক্রিয়ার মুখে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদাধিকারীর নির্দেশও আজ আর নতুন কিছু নয়। আর দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ডকে গ্রপ্তার করা সম্ভব হলো না এবং তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেন। আমরা এতেও অবাক হওয়ার মতো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কারণ, সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মনে আশঙ্কা জেগেছিল, নয়ন বন্ডের এই পরিণতি হতে পারে। কিন্তু আমরা এটা চাইনি।

বাংলাদেশে সব অস্বাভাবিকতাই যেন স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। এ বড় বিপদের কথা। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর যাবতীয় উন্নয়ন নিষ্ফল হবে, যদি সমাজ থেকে স্বাভাবিক শান্তি ও স্বস্তি বিদায় নেয়, নিরাপত্তাবোধ ভেঙে পড়ে। যাঁরা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, তাঁরা যদি এটা উপলব্ধি করতে না পারেন, তাহলে জন্মভূমি বাংলাদেশ হয়তো একদিন আমাদের সন্তানসন্ততির কাছে বসবাসের যোগ্য থাকবে না।

মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]