রুমানার দেশ

গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে রুমানা বক্তব্য দেন
গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে রুমানা বক্তব্য দেন

কেমন ছিল সেই দিনটি? সেই ৫ জুন ২০১১? যেদিন স্বামীর আঘাতে রক্তাক্ত রুমানা অন্ধ হয়ে গেলেন? আমরা নিশ্চয় ভুলে যাইনি রুমানাকে? সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানার চোখ চিরদিনের মতো চলে গেল যেদিন। তারপর কেমন আছেন রুমানা? কী করে তাঁর জীবন কাটছে?

রুমানা দেশ থেকে অন্ধ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন এ দেশের ‘ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া’ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করে, তারপর আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। অদম্য রুমানা এখন আইনবিদ। প্রতিদিন সকাল ৮টা-বিকেল ৫টা অফিস, নানা জায়গায় নারীর অধিকার বিষয়ে বক্তৃতার আমন্ত্রণ পান রুমানা। সেখানে অনেক সমস্যাক্রান্ত নারী তাঁদের জীবনের প্রেরণা খুঁজতে রুমানার কাছে আসেন। অনেক মানুষের আইনের অধিকার নিশ্চিত করেন তিনি এখন। একজন স্বাধীন নারী হিসেবে সর্বোতভাবে আত্মবিশ্বাসী রুমানা এখন মানুষকে আশার কথা শোনান। শূন্যতায় কী করে আশার আলো জ্বেলে দিতে হয়, রুমানা সেই গল্প বলেন।

রুমানার এখনো মনে পড়ে সেদিনটা। বেশ ঝকঝকে রোদের দিন ছিল, জানালার গরাদে পাখি এসে বসেছিল। নিজেকে দেখার শেষ স্মৃতি যদিও এখন আবছা হয়ে এসেছে তাঁর। নিজের চেহারাটা কেমন ছিল মনে পড়ে না আর। গোলাপকুঁড়ি এসেছিল বারান্দার টবে, রুমানা কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলেন এই তাঁর শেষ গোলাপ দেখা? গ্রীষ্মদগ্ধ রোদের মধ্যে সাদা ফুলের মতো কন্যা আনুশের মুখটাও শেষবারের মতো দেখা। সেই ৫ জুন ছিল রুমানার শেষ আলোর পৃথিবী দেখার দিন। সেই তাঁর কল্কে নকশা আঁকা প্রিয় লাল কামিজে শেষ নিজেকে আয়নায় দেখা। চোখে অনিক্স রাশের কালো কাজল ছিল। নিজের বাড়িতে মায়ের ঘরে কাজ করছিলেন রুমানা কম্পিউটারে, পাশেই আনুশে খেলা করছিল। আচমকা পেছন থেকে আঘাত করলেন তাঁর স্বামী। কিছু বোঝার আগেই রুমানার ওপরে এলোপাতারি আক্রমণ নেমে এল। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন প্রাণপণ, কিন্তু চোখটাতে এমন আঘাত এল, এমন নাক–মুখ সব থেঁতলে গেল, তাতেও ক্ষান্ত হলেন না। শেষে রুমানার দুই চোখে লোকটি তাঁর আঙুল ঢুকিয়ে দিলেন, গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে, তাঁর দুচোখে আচমকা ঘন আঁধার ঘনিয়ে এল। সেই দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে এখনো তাড়িয়ে ফেরে।

দৃষ্টিহীন রুমানা এখন শব্দ–গন্ধভুক। স্পর্শ–গন্ধময়তা, শব্দসংবেদনার এক অবিশ্বাস্য পৃথিবীতে বাস করেন তিনি। মেঘের ডাক, পাতার সরসর শব্দরাজি, পাখির ডানা ঝাপটানোতে, সমুদ্রের জলরাশির নিবিড় কোলাহলে তাঁর দিনপঞ্জি বাঁধা পড়েছে। কানাডার বেগুনি মার্টিন পাখি ডানা ঝাপটালে তার পালকের প্রতিধ্বনিতে রুমানা বোঝেন আজ বৃষ্টি, আবার তৃষ্ণার্ত পাখির স্বরে দগ্ধদিনের কর্কশতা টের পান। চারপাশে সমুদ্র–জলরাশিবেষ্টিত আমাদের এই ক্যাম্পাসে যখন সিগাল পাখি অবিরাম ডেকে চলে, রুমানা আগাম ঝড়ের বার্তা পান। ডাহুক রোজমেরির রস খেয়ে কোথায় কুঁইকুঁই ডেকে যাচ্ছে—রুমানা ঠিক জানেন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। ডেইজি ফুলের জংলি ছাপা জামায় হাত রেখে বলে দেন, আমি আজ লাল রং পরেছি। রুমানা যেন আর মানুষ নেই। প্রকৃতিচারী বুনো পাখির পালক গজিয়েছে তাঁর দেহে। ইকোলোকেশনের রহস্যময় শব্দ-স্পর্শ–গন্ধময়তার সূক্ষ্ম পতঙ্গজগতে তাঁর বাস। রুমানার চোখে এখন অ্যাকোয়ামেরিন বাদামি পাথর বসানো। গভীর সমুদ্রতলদেশ থেকে আহরিত এই পাথরের ধূসর সবুজাভ দ্রবণ দ্যুতি মানুষের চোখের মতোই বিদ্যুৎময়। শুধু সেই চোখে আর কোনো আলোর সংবেদনা নেই।

সেদিন এখানে দেখানো হলো ডকুমেন্টারি ‘আনটাই দ্য নট’। বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের মেয়েদের স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। সেখানে ছিল রুমানার জীবনকাহিনির অংশবিশেষ। সেটা দেখতে জড়ো হয়েছিল শত শত মানুষ। এসেছিলেন রুমানার বন্ধু–সহকর্মীরা। রুমানার অদম্য জীবনস্পৃহা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন সবাই। অন্ধ হয়ে তিনি কী করে এমন প্রতিষ্ঠা পেলেন, কেমন করে স্বনির্ভর হলেন—এসবই ছিল আলোচনার বিষয়। ছবির শেষে রুমানার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন সবাই। তাঁর পাথরের চোখ ঠিক ঠিক একরাশ দ্যুতি ছড়িয়ে প্রতি উত্তর করল। দৃষ্টিহীন হয়েও স্পর্শ–গন্ধময়তার এমন নির্ভুল জীবনযাপন আয়ত্ত করেছেন কী করে রুমানা?

রাস্তায় চলেন স্বাধীন ও একাকী। লাল-সাদা ছড়ি ঠেকিয়ে শান্ত উপত্যকার জলটা পার হন, বাড়ির পাশে বন–বনানী থেকে পাখির ডাকে সকাল, সন্ধ্যে তাঁর কাছে আলাদা আলাদা হয়ে ধরা দেয়। নিজের শোবার ঘরের ক্লজেট খুলে খয়েরি স্কার্ফটা নিজেই বের করে পরে নেন। হাতের স্পর্শে বুঝতে পারেন কোনটা কী পোশাক। বাদামি পুলওভারের নিচে সাদা মেগনোলিয়া ফুলের ছোপ ছোপ রাউন্ড নেক জামাটা যখনই বের করেন, তখনই দেশের কাঁঠালচাঁপার বুনো গন্ধ আসে। শার্টিন স্কার্ফে জড়িয়ে থাকে মধুমিতা সিনেমা হলের ঠান্ডা একটা গন্ধ। দেশের শ্রাবণের গন্ধ, শরতের গন্ধ—এভাবে স্মৃতির গন্ধগুলো আলাদা হয়ে বেঁচে আছে তাঁর জীবনে। রুমানা বিশ্বাস করেন, এই গন্ধগুলো পাখিরা নিয়ে আসে তাঁর কাছে। এই সব স্মৃতির গন্ধই এখন রুমানার দেশ।

গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে রুমানা বক্তব্য দেন
গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে রুমানা বক্তব্য দেন

সিনেমাতে দেখা যায়, রুমানা কাজল পরছেন, অনেকে অশ্রুভারানত হয়েছেন এ দৃশ্যে। এমনকি চোখের ওপরে এমারেল্ড গ্রিন শেডের একটু ছায়া কেঁপে ওঠে যখন—এই দৃশ্যে ঝমঝম করতে থাকে শরীর। রুমানার চোখ থাকার সময়ের স্মৃতি আসে। সেফোরার কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটা তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমার চোখের মণির সঙ্গে সবুজ ভারি মানানসই।’ তখন থেকে রুমানা ঘন কালো কাজলের সঙ্গে সবুজ শেড পরেন। বের হওয়ার সময় কন্যা আনুশে তাঁকে সবকিছু পরিপাটি গুছিয়ে দেয়। আনুশে এখন রুমানার আয়না। দর্শকসারি থেকে ক্যাথরিন জানতে চেয়েছিলেন, যখন অন্ধকারকে তিনি ভয় পেয়েছিলেন, যখন চন্দ্র–সূর্য–নক্ষত্র নিশানা চিরদিনের জন্য ঘুচে গিয়েছিল, কী করেছিলেন তিনি তখন? কী করে এতটা পথ পার হলেন রুমানা?

রুমানা একরাশ হাসি ছড়িয়ে দেন—‘আমি এখন দেখতে পাই না, কিন্তু পাখি–পতঙ্গের মতোই আমার অন্য ইন্দ্রিয়গুলো অনেক বেশি তৎপর।’

রুমানার জীবনে আর কোনো বই, কাগজ, কলম লেখাজোখার ব্যাপার নেই। আগের জীবনের নিউমার্কেটের কর্ণফুলী পেপারের সঘন গন্ধের স্মৃতি রয়ে গেছে কেবল। চারকোল প্রিয় ছিল, মনে পড়ে খড়খড়ে নিবে চিনেরির ‘বেঙ্গলি ভিলেজ সিন’ এঁকেছিলেন, সুলেখা ক্যালিগাফিক অ্যাসিড ফ্রি পিগমেন্ট কিনতেন নানা দোকান ঘুরে ঘুরে। এখন ল্যাপটপে ‘গস’ নামে সফটওয়্যারে লেখেন। অক্ষরগুলো শব্দ হয়ে কানে আসে টাইপ করার সময়। চোখ চলে গিয়ে যে ইন্দ্রিয় জন্ম নিল, তা বুনো প্রকৃতির মতো সংবেদনশীল।

বাড়ি যাওয়ার পথে জঙ্গলের রাস্তাটা পুরোনো ছাতিম-জারুল তলায় গিয়ে মিলেছে। পাখির কলস্বরের প্রকৃতিচারী প্রাণীর মতো রুমানা টের পান তার তীব্র সেঁদো গন্ধ। কোথায় ক্যালমিয়া, যূঁথি গন্ধ ছড়ায়; কুঁইকুঁই স্বরে একটা ক্যানারি পাখি পুরো পথটায় ওর জন্য ডেকে চলে। ওরিগন গাছের বিশাল ছায়াটা এখানে টইটম্বুর কষ–কষ গন্ধে ঠাসা। আর কিছুদূর হেঁটে গেলে অ্যাজেলিয়া চেরিগাছের ছায়ায় দোয়েলের শিস কানে ভেসে আসে। তারপর ঠিক বাতাবিলেবুর গন্ধটা সাঁঝের বাতির মতো জ্বলে ওঠে। এই হিসাবে তিনি এখন পাকা। জানেন, আরও কিছুদূর হাঁটলেই ২৬৬৪ টেনিস ক্রিসেন্ট রাস্তার ধারে তাঁর বাড়িটা।

মনে পড়ে, রুমানার চোখ ছিল তখনো। বাংলাদেশের পতাকা ছিল না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসবের ডিনার পার্টি সেবার বয়কট করেছিলেন। তারপর তো রুমানা দেশে গেলেন থিসিসের কাজে। বদলে গেল ওর জীবনটা। ফিরে এলেন অন্ধ হয়ে।

রুমানা একরাশ হাসি ছড়িয়ে দেন—‘আমি এখন দেখতে পাই না কিন্তু পাখি–পতঙ্গের মতোই আমার অন্য ইন্দ্রিয়গুলো অনেক বেশি তৎপর।’
রুমানা একরাশ হাসি ছড়িয়ে দেন—‘আমি এখন দেখতে পাই না কিন্তু পাখি–পতঙ্গের মতোই আমার অন্য ইন্দ্রিয়গুলো অনেক বেশি তৎপর।’

রুমানা বলেন, ‘কেমন ছিলাম দেখতে আমি? কিছু মনে নেই।’ শুধু মনে আছে হাই পাওয়ার প্যাথিড্রিনে গুমোট ক্লোরাফিলের গন্ধে হাসপাতালের বিছানায় নিঃসাড় পড়ে থাকার শেষ অন্ধকার দিনগুলোর কথা। ডাক্তার বলেছিলেন, ‘কোনো দিন দেখতে পাব না আর।’ সেই হাসপাতালের বিছানাতে দুচোখে গাঢ় অন্ধকার নিয়ে তিনি ভাবছিলেন আনুশের কথা। ওর সঙ্গে খেলার অনুষঙ্গ সেই শ্রাবণে দগ্ধ পতঙ্গ বোতলে পুরে জলে ডোবানোর কথা ছিল তিন সত্যি গুণে। মা-মেয়ের খেলার সেই জলঘাট টইটুম্বুর বাংলাদেশের শ্রাবণ আর কোনো দিন ফিরে আসেনি রুমানার জীবনে। অডিটরিয়ামের পর্দায় ভেসে আসছে বাংলাদেশের আকাশ। পাখি উড়ে যায়...কন্যা আনুশেকে জড়িয়ে আদর করেন রুমানা।

কন্যা আনুশে বলে, ‘মা তোমার হাতটাই কি এখন চোখ হয়ে গেছে?’

গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া।
[email protected]