মাদক নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনা ও বিধান

মানবজীবনে শান্তি ও মুক্তির জন্য প্রয়োজন প্রকৃতির অনুকূল আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা। ইমান মানে বিশ্বাস ও নিরাপত্তা এবং সমাজের কল্যাণে  নিবেদিত হওয়া। ইসলামি শরিয়তের সব বিধান এই আলোকেই সুবিন্যস্ত। 

ইসলামে মাদক সেবন নিষিদ্ধ। ইসলামে অন্য যেসব নিষিদ্ধ বা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত বিষয় রয়েছে, সেগুলো থেকে ব্যক্তি চাইলেই সহজে বিরত থাকতে পারে। অর্থাৎ, ইচ্ছা করলে এসব অপরাধ থেকে সরে থাকা যায়। কিন্তু মাদক গ্রহণ এমন এক অপরাধ, যা নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না; বরং মাদকসেবী নিজেই মাদক বা নেশার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। চাইলেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। অর্থাৎ, সে নেশাকে ছাড়তে চাইলেও নেশা তাকে সহজে ছাড়ে না বা ছাড়তে চায় না। 

মূল পঞ্চ নিষেধের চারটি অপরাধ পরিত্যাগ করে তওবা করে পবিত্র জীবন যাপন করা সম্ভব, কিন্তু নেশা বা মাদকাসক্ত ব্যক্তি তওবা করারও সুযোগ পায় না এবং মাদক না ছেড়ে তওবা করলেও তা কবুল হয় না। 

মাদক হলো অপরাধের আকর। কোরআন কারিমে বর্ণিত হারুত ও মারুত এই মাদকের নেশায় মাতাল হয়েই জোহরার ইশারায় হত্যা, ব্যভিচারসহ নানান অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১০২; তাফসিরে আজিজি ও তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)। 

মাদক হলো নেশা উদ্রেককারী সব বস্তু, যা মানুষের মস্তিষ্কের স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করে দেয়, যার প্রভাবে মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করে না। মাদক সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধকে উত্সাহিত করে। শরিয়তের বিধানের দর্শনকে ‘মাকসিদে শরিয়া’ নামে অভিহিত করা হয়। 

শরিয়তের উদ্দেশ্য হলো পাঁচটি। জীবন রক্ষা, সম্পদ রক্ষা, জ্ঞান রক্ষা, বংশ রক্ষা, বিশ্বাস বা ধর্ম রক্ষা। হত্যার পরিবর্তে হত্যার বিধান রাখা হয়েছে জীবন সুরক্ষার জন্য। সেখানেও রয়েছে দিয়াত বা রক্তপণ দিয়ে নিহতের অভিভাবকের কাছ থেকে ক্ষমার সুযোগ। চুরির দায়ে হাত কাটার বিধান আছে সম্পদ সুরক্ষার জন্য। এখানেও রয়েছে অপেশাদার অভাবীদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা ও ক্ষমার সুযোগ। সব ধরনের মাদক বা নেশাদ্রব্য হারাম করা হয়েছে জ্ঞান বা বুদ্ধি–বিবেক সুরক্ষার জন্য। মাদক গ্রহণের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা রয়েছে। 

কোরআন কারিমে মাদক নিষিদ্ধের বিষয়টি তিনটি ধাপে এসেছে। প্রথমে বলা হয়েছে, ‘লোকেরা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, এতদোভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য অপকারও, কিন্তু এগুলোতে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২১৯)। 

দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হলো, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, পূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, এগুলো শয়তানের কার্য। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৯০)। 

সর্বশেষে ঘোষণা করা হলো, ‘শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদিগকে আল্লাহর স্মরণে ও নামাজে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৯১)। 

সাহাবি হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের কিছু নিদর্শন হলো ইলম লোপ পাবে, অজ্ঞানতার বিস্তার ঘটবে, মদ্যপান ও মাদকের প্রসার ঘটবে, ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে’ (বুখারি, প্রথম খণ্ড, হাদিস: ৮০)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে মিরাজের রাতে বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি দেখানো হয়েছে। ‘তিনি মদ, মাদক ও নেশা গ্রহণকারীদের শাস্তি দেখলেন। তারা জাহান্নামিদের শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত নোংরা পুঁজ পান করছে’ (বুখারি ও মুসলিম, মিরাজ অধ্যায়)। ফিকাহ তথা ইসলামি ব্যবহারিক বিধানমতে মাদক গ্রহণ হারাম হওয়ার পাশাপাশি তা অপবিত্রও। কোনো মুসলমানের মাদক ব্যবহার করা যেমন হারাম, অনুরূপভাবে তা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ করা এবং ক্রয়–বিক্রয় করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। 

বিশ্বশান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য সর্বস্তরে মাদক পরিহার করতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও পারিবারিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ শুধু আইনি ও সামাজিক বিষয় নয়, বরং এটি ইমান ও আমলের সঙ্গে সম্পর্কিত অতীব জরুরি বিষয়। 

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক