অন্যায়ের প্রতিকার প্রতি-অন্যায়!

ছবিটি প্রতীকী
ছবিটি প্রতীকী

চোর ধরা পড়েছে এবং জনতা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে—এ সমাজে এটি অতি সাধারণ খবর। এই খবর পড়ার পর ‘সংশ্লিষ্ট’ চোরের মৃত্যু–মুহূর্তের ছবি কল্পনাদৃশ্যে চিত্রায়িত করে ‘আহা রে!’ বলার চল এই দেশে নাই। মৃত (‘নিহত’ নয়!) চোরের প্রতি সামান্যতম অনুকম্পা প্রদর্শন করতে গেলে তার ‘মাসতুতো ভাই’ হয়ে যাওয়ার প্রবল ঝুঁকি আছে।

প্রায়ই খবর বেরোয়, অমুক জায়গায় চোর সন্দেহে গণধোলাইয়ে তমুক নিহত। সংবাদপত্রের ধারাভাষ্যে কিংবা টেলিভিশনে সংবাদ পাঠকের বাঙ্ময় উচ্চারণে ‘গণধোলাই’, ‘গণপিটুনি’—এই যৌগিক শব্দ পাঠক-শ্রোতার কাছে খুব উপাদেয় হয়ে ওঠে। এই শব্দগুলোর মধ্যে পিটিয়ে চোর মেরে ফেলার নৈতিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সূক্ষ্মতম চেষ্টা নিহিত থাকে। এই শব্দগুলোর মধ্যে জনতার রায়ে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার বিষয়ে প্রচ্ছন্ন সম্মতি জড়িয়ে থাকে।

প্রাচীন রোমে অপরাধীকে কলোসিয়ামের মাঝখানে বাঘের খাঁচায় ফেলে দেওয়া হতো। কোথাও কোথাও অপরাধীকে প্রকাশ্যে পাথর ছুড়ে বা হাতির পায়ে পিষ্ট করে অথবা রথের চাকায় জুড়ে দিয়ে কিংবা সরাসরি আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। নিরপরাধ মানুষেরা সেই দৃশ্য অবলোকনের মধ্য দিয়ে ‘নির্মল’ আনন্দ উপভোগ করত। অপরাধীর সাজাপ্রাপ্তির সেই দৃশ্য তাদের নিজেদের নিরপরাধ ও ‘নিষ্কলুষ’ ভাবতে প্ররোচিত করত।

আজকে নতুন ‘সভ্যতা’য় এসে সেই পুরোনো শাস্তির বর্বরতা আমরা কীভাবে ধরে রেখেছি, তা এক বিস্ময়। সভ্যতার ভেতরেই বর্বরতা নিহিত—এই নিষ্ঠুর সত্য মাঝেমধ্যে গণধোলাইয়ের খবরের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে। গণধোলাই আজও আমাদের দেশে জনতার আদালতে নির্ধারিত এক সুপরিচিত শাস্তি। সেই দৃশ্যে আমরা তুমুল উৎসব দেখি। এর মধ্য দিয়ে প্রচলিত বিচার এবং সাজার আধুনিক মোড়ক ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমরা নিজেদের মতো করে প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতার মৌতাত নিই।

গত ২৫ জুন দিবাগত রাতে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় গণপিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যু হয়। গ্রামবাসীর ভাষ্য, ওই যুবক চোর চক্রের সদস্য ছিলেন। এক বাড়িতে দলবল নিয়ে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে এলাকার লোকজন পিটিয়ে তাঁকে মেরে ফেলেন। লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের বক্তব্য ছিল, এই চোর দলের উৎপাতে গ্রামবাসী অতিষ্ঠ ছিলেন। চুরির প্রস্তুতির সময় একজন ধরা পড়েছে। পাবলিক তাঁকে ধরে গণপিটুনি দিয়েছে। পিটুনিতে তিনি মারা গেছেন। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি।

‘গণপিটুনিতে নিহত’ কথাটি লিখে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখেছি, এ–সংক্রান্ত অসংখ্য খবরের লিংক চলে আসে। প্রায় সবগুলো খবর পড়ে বোঝা গেল, চোর বা ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে কেউ মারা গেলে সে ঘটনায় সাধারণত কেউ আটক হয় না। দীর্ঘদিন ধরে সমাজে চলে আসা চর্চার কারণে পুলিশ গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনাকে ‘খুন’ ভাবতে পারে না। তারাও হয়তো এটিকে ‘উচিত সাজা’ সাব্যস্ত করে। এ ধরনের ঘটনায় কাউকে আটক না করার হয়তো এটিই প্রধান মনস্তাত্ত্বিক কারণ।

অনেকে যুক্তি দিয়ে বলতে পারেন, ছাড়া পেয়ে গেলে সাধারণত যেহেতু এদের বিচার হতে দেখা যায় না, সেহেতু গণপিটুনিই ঠিক শাস্তি। এটিকেই ন্যায়বিচার ভাবার মধ্যে হয়তো একধরনের ভরসাও থাকে; ভেবে নেওয়া হয়, গণপিটুনিতে মৃত্যুর মতো কঠোর শাস্তির ভয়ে অন্যায়–অপরাধ করার প্রবণতা কিছুটা কমতে পারে।

কিন্তু ইতিহাস বলছে, সেই ভরসার কোনো ভিত্তি নেই। ২০১১ সালে পবিত্র শবে বরাতের রাতে সাভারের আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে এলাকাবাসী ছয়জন তরুণকে মেরে ফেলেন। তাঁরা মারা যাওয়ার পর জানা গিয়েছিল, ওই তরুণেরা সবাই ছিলেন ছাত্র। তারুণ্যের ফ্যান্টাসি থেকে রাতে তাঁরা ঘুরতে গিয়েছিলেন। ওই এলাকার বাসিন্দারা ডাকাতের উপদ্রবে অতিষ্ঠ ছিলেন। হঠাৎ গভীর রাতে অপরিচিত একদল তরুণকে দেখে তাঁদের ডাকাত বলে মনে হয়েছিল। মৃত্যুর পরও যতক্ষণ ওই তরুণেরা এলাকাবাসীর কাছে ‘ডাকাত’ ছিলেন, ততক্ষণ এলাকাবাসী বিবেকতাড়না থেকে মুক্ত ছিলেন। যেই মাত্র জানা গেল তাঁরা নির্দোষ ছিলেন, অমনি ‘আহা রে! উহু রে!’ বিধিবদ্ধ আইন ও প্রচলিত বিচারব্যবস্থার ওপর এলাকাবাসীর আস্থা থাকলে তাঁরা ‘ডাকাত’ হিসেবেই ছেলেগুলোকে ধরে পুলিশে দিতেন। এভাবে মেরে ফেলতেন না।

ইতিহাসে অনেক জননায়ক বলেছেন, অন্যায়কে শায়েস্তা করতে গেলে প্রতি-অন্যায় এক চমৎকার উপায়। এই প্রতি-অন্যায়ে তাঁরা প্রবল জনসমর্থনও পেয়েছেন। খুন, লুণ্ঠন করা সত্ত্বেও জনতা রবিনহুড বা দস্যু বনহুরকে ভালোবাসে এবং মনে করে, আগে যে অন্যায় করেছে, তার প্রতি পাল্টা-অন্যায় করলে তা মোক্ষম ন্যায়ই হয়।

এই দেশে এক শ টাকার জুতো চুরির সন্দেহে জনতার আদালত তাৎক্ষণিকভাবে সন্দেহভাজন চোরকে ‘মৃত্যুদণ্ড’ দিয়ে তা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করে। ‘ক্ষমা যেথা হীন দুর্বলতা’—সেই স্থলে তারা নিষ্ঠুর হতে পারার প্রার্থনা করে। তাদের কাছে ক্ষমা দৌর্বল্যের অভিজ্ঞান বলে ধিক্কৃত। তুমি দুর্বল বলে ক্ষমা করে দিয়ে তোমার অক্ষমতা ঢাকছ, সবল হলে তুমি হিংসার জবাব প্রতিহিংসায় চুকিয়ে দিতে—এই যুগধর্মের অনুসারী বাড়ছে। অতি আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে পাবলিক জুতো চোরকে ক্ষমা করে না, অবলীলায় পিটিয়ে মেরে ফেলে, সেই একই পাবলিক তাদেরই হাজার কোটি টাকা চুরি করা সর্বজনবিদিত চোরদের প্রতি কী এক রহস্যময় কারণে অনুকম্পা বর্ষণ করে।

গণপিটুনিতে মানুষ মেরে ফেলা, ক্রসফায়ারে কুখ্যাত খুনির মৃত্যু কামনা করা বা চোখের বদলে চোখ উপড়ে নেওয়ার প্রবণতা একজন বা দশজন ব্যক্তির থাকতেই পারে। কিন্তু গোটা সমাজ যদি এটিকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে তো বিপদ। সমাজে চাপাতি হাতে নির্দয়ভাবে কুপিয়ে মানুষ হত্যা করা নয়ন বন্ডরা থাকবেই। প্রতি–অন্যায়ের মধ্য দিয়ে তাদের শেষ করার আকাঙ্ক্ষাও অনেকে প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু দিন শেষে রাষ্ট্র ও সমাজকে ক্ষুদ্র ব্যক্তিধারণার ঊর্ধ্বে অবস্থান করতেই হবে। ব্যক্তিকে অতিক্রম করে রাষ্ট্রের পরিসরে ঘৃণাই শাসনযন্ত্রের চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারে না। অন্যায় ঠেকাতে গিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ যদি প্রতি-অন্যায়ের মতো অন্যায় পদ্ধতি গ্রহণ করে, তাহলে বুঝতে হবে অপরাধীর তুলনায় সে উন্নত হতে পারেনি। বুঝতে হবে সে–ও অপরাধীদের মতো অসভ্যতারই উপাসনা করছে।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জেযষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin 2003 @gmail. com