রাহুলের চিঠি ও নতুন রাজনীতির খোঁজ

রাহুল গান্ধী। ছবি: রয়টার্স
রাহুল গান্ধী। ছবি: রয়টার্স

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করার জন্য রাহুল গান্ধী যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, তাতে ভারতের রাষ্ট্র ও রাজনীতির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা ভারতের রাজনীতি নিয়ে যাঁরা উৎসাহী, কেবল তাঁদের জন্যই নয়, যাঁরা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহী, তাঁদের জন্যও কৌতূহলোদ্দীপক। এর বাইরে সারা পৃথিবীতে জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান বিষয়ে যাঁরা পঠনপাঠন করেন, তাঁদের কাছেও এর গুরুত্ব আছে বলেই আমার ধারণা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র বলে যে ভারতের পরিচয়, তার সঙ্গে রাহুল গান্ধীর এই চিঠির অমিলই কেবল সহজে দৃশ্যমান তা নয়, এই চিঠি ভারতের রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্যও উদ্বেগের।

গত ২৩ মে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরই যেসব প্রশ্ন উঠেছিল, তার মধ্যে কংগ্রেস ও তার নেতা রাহুল গান্ধীর ভবিষ্যৎ কী, এই প্রশ্ন ছিল। ছিল এই প্রশ্নও যে বিভিন্ন ধরনের সূচকে যেখানে বিজেপির বিজয়ের কারণ দেখা যায়নি, অন্ততপক্ষে এত বড় বিজয়ের লক্ষণ দেখা যায়নি, সেখানে বিজেপি ও তার নেতা নরেন্দ্র মোদি কীভাবে এত বড় বিজয় অর্জন করলেন। রাহুল গান্ধীর পদত্যাগপত্রে এসব প্রশ্নের উত্তর কিছুটা হলেও পাওয়া যাচ্ছে।

প্রথমত, কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে দলের আদর্শিক অবস্থান ও নেতৃত্বের বদল করার ওপর। রাহুল গান্ধী সেই আহ্বান জানিয়ে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন—দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এটি একটি বিরল ঘটনা; তদুপরি তা এসেছে উত্তরাধিকারের রাজনীতির ধারক একজনের কাছ থেকে। বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই এখন উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে ভাটার টান চলছে। সেদিক থেকেও এই সরে দাঁড়ানো এবং দলের অন্য নেতাদের এই শর্ত দেওয়া যে তাঁর বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বা মা সোনিয়া গান্ধীকে দলের প্রধানের পদে আসীন করা যাবে না, তা আমাদের সবার মনোযোগ দাবি করে। শেষ শর্ত আপাতত মানলেও দল ভবিষ্যতে কী করবে, আমরা তা এখনই বলতে পারি না।

এই পত্র যে কেবল কংগ্রেসের পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করে নিজের দায়িত্ব নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, তা নয়। সেখানেই এই পত্র আমাদের সবার বিবেচনার দাবি করে এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের একটা উত্তর উপস্থাপন করে। বিজেপি কেন ও কীভাবে বিজয়ী হয়েছে, তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা আমরা একাডেমিক ও গবেষকদের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই পাচ্ছি এবং ভবিষ্যতে আরও পাব। ফলে এখনই এই ব্যাখ্যাকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করার অবকাশ নেই। ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় ধরে যে দল ক্ষমতায় ছিল, রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে এবং একার্থে ভারতীয় রাষ্ট্র তৈরি করেছে, তার প্রধানের কথাগুলোকে আমরা সহজেই খারিজ করে দিতে পারি না। একে পরাজিতের আত্মপক্ষ সমর্থন মনে করার কারণ নেই।

রাহুল গান্ধী চিঠিতে স্পষ্ট করেই বলেছেন যে ভারতীয় রাষ্ট্র এই নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি। তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে যে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন বিরোধীদের বিপক্ষে কাজ করেছে। তিনি লিখেছেন, ‘একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সেই দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা আবশ্যক; কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়া একটা নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না—অবাধ গণমাধ্যম, স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং একটা বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন হচ্ছে সেই মধ্যস্থতাকারী। যদি আর্থিক সম্পদের ওপর কেবল একটা দলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকে, তবে নির্বাচন অবাধ হয় না।’ শুধু তা-ই নয়, তিনি লিখেছেন, ‘২০১৯ সালের নির্বাচনে আমরা একটা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে লড়াই করিনি। বরং আমরা ভারতীয় রাষ্ট্রের গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি; প্রতিটা প্রতিষ্ঠান, যেটা ক্ষমতাসীন দলের বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে আমাদের একদা মর্যাদাবান প্রতিষ্ঠানসমূহের নিরপেক্ষতা এখন আর ভারতে নেই।’

যে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একসময় রাজনৈতিক ও দলীয় আদর্শের ঊর্ধ্বে বলেই বলা হতো, যে নির্বাচন কমিশনকে একসময় দক্ষিণ এশিয়ায় উদাহরণ বলে গণ্য করা হতো, সেগুলোর বিরুদ্ধে উত্থাপিত এই অভিযোগ থেকে বলা যায় যে এখন আর সেগুলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকল না। এ কেবল ভারতের প্রশাসনের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতির অবসানের ইঙ্গিত নয়, রাষ্ট্র ও দলের মধ্যকার পার্থক্যের অবসান বটে। এটি কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের লক্ষণ নয়।

ভারতের গণতন্ত্রের জন্য এই অশনিসংকেতের সূচনা হয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু এখন তা কি পূর্ণ রূপ নিয়েছে? গত পাঁচ বছরে বিজেপির শাসনের সময়ে যে অসহিষ্ণু ভারতের চেহারা আমরা দেখতে পেয়েছি, যেখানে ভিন্নমত বিবেচিত হয়েছে দেশদ্রোহ বলে, যেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন-নির্যাতন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। রাহুল গান্ধী লিখেছেন, ‘আরএসএসের যে ব্যক্ত উদ্দেশ্য ছিল আমাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে জবরদখল করা, তা এখন ষোলোকলায় পূর্ণ হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্র মৌলিকভাবে দুর্বল হয়েছে। আসল বিপদের কথা হলো, ভারতের আগামী নির্বাচনগুলো দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের উপায় না হয়ে কেবল নিয়মরক্ষার উপায়ে পরিণত হতে যাচ্ছে।’ কর্তৃত্ববাদী শাসনের এগুলো কেবল লক্ষণ নয়, তার প্রাণবস্তু। জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্ববাদের প্রধান কাজ হচ্ছে সব প্রতিষ্ঠানকে তার অধীন করা, আদর্শের বাতাবরণে তার এই কাজকে বৈধতা দেওয়া। যে কারণে এই ধরনের ক্ষমতার বিন্যাসকে কেবল সরকার বলে বিবেচনা না করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এদের বলা হয় ‘রেজিম’, যা প্রচলিত সরকারের চেয়ে বেশি স্থায়ী ও প্রভাবশালী, কিন্তু রাষ্ট্রের চেয়ে কম স্থায়ী। এই ধরনের শাসন কেবল শাসন করে না, এগুলো সমাজের ক্ষমতাকাঠামো ও সংস্কৃতিকে বদলে দেয়। ভারতে বিজেপি সরকারকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের বিজয়ের পর, সেভাবেই বিবেচনা করা দরকার। এর উদাহরণ আরও আছে, এই অঞ্চলে এবং এর বাইরে।

আদর্শিকভাবে ভারত কীভাবে এই অবস্থায় উপনীত হয়েছে? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। ধর্ম ও উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে, এই দুইয়ের মিশেলে যে আদর্শের প্রচার আরএসএস এবং বিজেপি সফলভাবে করতে সক্ষম হয়েছে, তার উদ্ভবের সময় তার মোকাবিলা করতে কংগ্রেস বা ভারতের অন্য দলগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ক্ষমতালাভের উৎসাহে কংগ্রেস যে হিন্দুত্ব আদর্শের একটি নরম ভাষ্যকেই একসময় গ্রহণ করেছিল এবং এমনকি এই নির্বাচনেও যে তা থেকে একেবারে সরে আসেনি, আমরা তা-ও দেখতে পেয়েছি।

কিন্তু এই দায় অবশ্যই কংগ্রেসের একার নয়, ভারতের অন্যান্য দলকেও এই দায় নিতে হবে। গেরুয়াকরণের সামাজিক ও রাজনৈতিক উৎসকে মোকাবিলা করা, সেই আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করা, তার জন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সমাবেশ ঘটানোর কাজে তারা এগিয়ে আসেনি। বৃহৎ করপোরেট পুঁজি, বিকাশমান নতুন মধ্যবিত্ত এবং রাজনৈতিক দলের যে মেলবন্ধন ঘটেছে ভারতে, তার প্রতিনিধিত্ব করে বিজেপি এবং এর পারসনিফিকেশন হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। সেই বিবেচনা তাদের কতটা ছিল, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। বিরোধীদের রাজনীতি হয়েছে রিঅ্যাকটিভ, প্রোঅ্যাকটিভ নয়। পশ্চিমবঙ্গে একসময়কার বামপন্থীরাও যে এই নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রুখতে বিজেপিকেই বেছে নিল, তাতেই বোঝা যায় আদর্শের মোকাবিলায় আদর্শের চেয়ে কৌশলের প্রাধান্যই এই অবস্থা সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের
শাসনের মধ্যকার কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা এর অনুকূলেই কাজ করেছে।

কিন্তু সর্বভারতীয় পর্যায়ে ভারতের বিরোধী দলগুলো যে জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে এই নির্বাচনে সেই রাজনীতিকে মোকাবিলায় যথাযথ কৌশল তৈরি করতে পারেনি, সেটা স্পষ্ট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দেশে জনতুষ্টিবাদ ও কর্তৃত্ববাদবিরোধীরা গত দশকের বা তারও আগের রাজনীতির অভিজ্ঞতা দিয়েই এই নতুন রাজনীতি মোকাবিলা করতে চেষ্টা করে এবং ভারতেও তা-ই হয়েছে। সে কারণেই এই অভিজ্ঞতা কেবল ভারতের জন্যই প্রাসঙ্গিক তা নয়, যেসব দেশেই জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্ববাদের বিকাশ ঘটেছে, তৈরি হয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মাদনা, যেখানে ধর্মকে ব্যবহার করে কিংবা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে আশ্রয় করে মানুষের অধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে, যেখানে একধরনের উগ্রপন্থা মোকাবিলার নাম করে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আরেক ধরনের উগ্রপন্থা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে উদার রাষ্ট্রের চরিত্রের বদল ঘটেছে, সেখানে কীভাবে এই প্রবণতাগুলো রুখতে হবে, সেই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার দরকার।

ভারতের রাজনীতি এবং নির্বাচন থেকে ভারতের রাজনীতিবিদেরাই শুধু নন, অন্যরাও শিখছেন কি না, এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত আছেন কি না এবং সেই আলোকে নতুন ধরনের রাজনীতির সূচনা করতে সক্ষম কি না, সেটাই দেখার বিষয়।


আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর