আপনি প্রবীণ? পাঁচ মিনিট ব্যায়াম করুন

সেদিন প্রথম আলোর উদ্যোগে প্রবীণদের অধিকার নিয়ে আমরা গোলটেবিল বৈঠক করলাম। ধন্যবাদ দিই হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনালকে। বেসরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি নিরলসভাবে কাজ করছে। যেন প্রবীণেরা বঞ্চিত না হন। ওরা ছিল এই আয়োজনে সহযোগী। আমাদের দেশে প্রবীণদের অসহায় অবস্থার কথা আমরা সবাই জানি। আগের যুগের সেই পারিবারিক বন্ধন এখন শিথিল হয়ে আসছে। আর সেই সঙ্গে একসময়ের সংসারের প্রধান ব্যক্তিটি বয়সের কারণে পরিবারে সবচেয়ে উপেক্ষিত ব্যক্তি হয়ে যাচ্ছেন। এমনকি তিনি সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।

আমাদের দেশে প্রবীণদের এটা এক বিরাট সমস্যা। সরকার কিছু আইন করেছে। গ্রামের গরিব পরিবারের প্রবীণদের আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থাও কিছু আছে। তাতে সবার হয় না। ভবিষ্যতে হয়তো হবে। কিন্তু যেটা হবে না, তা হলো সমাজ ও পরিবারে মোটামুটি প্রাপ্য সম্মান। এখন দেখা যায়, পরিবারের প্রবীণতম সদস্যকে সবাই যেন হেলাফেলার চোখে দেখেন। সব পরিবারে হয়তো এ রকম হয় না। কিন্তু বেশির ভাগ পরিবারেই প্রবীণদের এই দুর্ভোগ।

সরকার বেশ কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রবীণদের অধিকার সুরক্ষায় কিছু কঠোর আইন দেশে আছে। কেউ যদি তাঁর বয়স্ক পিতা-মাতার দায়িত্ব নিতে না চান, বা বাড়ি থেকে তাঁদের তাড়িয়ে দেন, তাহলে তাঁর বিচার হবে, জেল-জরিমানার ব্যবস্থাও আছে। উন্নত অনেক দেশেও এ ধরনের আইন নেই। আমাদের আছে। এটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আইন আরও আছে। যেমন সন্তানের পরিচয় শুধু পিতার নামে নয়, সেখানে মায়ের নামও থাকতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস। আমেরিকায়ও এমন আইন নেই। সেখানে কাজ করলে করো, না হলে বেতন নেই। অথচ আমরা আইনগতভাবে মায়ের সম্মান রেখেছি। এখন পিতৃত্বকালীন ছুটিও হয়েছে। প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক শিশুদের কল্যাণে আইন রয়েছে। এমন অনেক কল্যাণকর আইন আমাদের আছে। সব আইনে যে কাজ হচ্ছে, তা হয়তো নয়। সেটা আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা। কিন্তু আইনি অধিকার থাকা তো নিশ্চয়ই ভালো, খুব ভালো। আইনগুলো যে করা হয়েছে, এই সবই সরকারের অভাবনীয় পদক্ষেপ।

প্রবীণদের কল্যাণে সরকার অনেক কিছু করছে বটে, তবে যথেষ্ট না। আরও কিছু চাই। যেমন যাঁদের বয়স ৮০ বা ৯০ বছর, তাঁদের থাকা-খাওয়া, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, বিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় সুব্যবস্থার দায়িত্ব সরকার নিতে পারে। কারণ, আমাদের এখন গড় বয়স ৭৩ বছর। তাহলে ৮০-৯০ বছরের প্রবীণের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি না। শেষ কয়টা দিন তাঁরা যেন মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারেন এবং খুশিমনে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা জরুরি।

আমাদের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গ্রামের গরিব পরিবারের প্রবীণদের কল্যাণে সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি এটাও মনে করিয়ে দিলেন যে একা সরকারের পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। সেখানে সামাজিক উদ্যোগও চাই। আসলে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের উদ্যোগ খুব দরকার। সরকার যে প্রবীণ নিবাস চালায়, তার আরও উন্নয়নের কথা তিনি জানান। ৮ জুলাই প্রথম আলোর ১২ পৃষ্ঠায় আমাদের আলোচনায় অংশগ্রহণকারী সবার কথা নিয়ে একটি ক্রোড়পত্র ছাপা হয়েছে। সেখানে আলোচনার বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে।

মানুষের জীবনটা হলো এক কাপ সুস্বাদু চায়ের মতো। খুব মজা করে চা পান করি আর আনন্দে মনটা ভরে যায়। কিন্তু এক দিকে চা পানে আনন্দ বাড়ে, অন্য দিকে যত চা পান করি, ততই চা-কাপের তলানিতে চলে যাই। জীবনের এই গল্প সবার জন্য সত্য। তাহলে বয়স বাড়লে সমস্যা কী? সমস্যা একটাই। বয়স বাড়ুক, কিন্তু বার্ধক্যটা যেন মিষ্টিমধুর হয়। যেন পদে পদে অমর্যাদার আঘাতে জর্জরিত হতে না হয়।

আরেকটা কথা। আমাদের সবার চেষ্টা করতে হবে, বার্ধক্য যেন আরও একটু দেরিতে আসে এবং যেন বুড়ো হলেও সুস্থ-সবল, হাসিখুশি থাকতে পারি। এটাই বড় কথা। সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে সবাই অনেক জরুরি কথা বলেছেন। অনেক দামি দামি সুপারিশ করেছেন। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা খুব বেশি আসেনি। সেটা হলো আনন্দময় বার্ধক্যের জন্য আমাদের নিজেদের প্রত্যেকেরই কিছু করার আছে। এবং সেটা হলো ব্যায়াম।

আমরা যদি অন্তত মধ্য বয়স থেকে প্রতিদিন নিয়মিত সাধারণ কিছু ব্যায়াম করি এবং সেটা বার্ধক্য পর্যন্ত চালিয়ে যাই, তাহলে আমাদের বার্ধক্য বেশ আনন্দদায়ক হবে। অবশ্য কেউ বলবেন, যেখানে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খেটে খায়, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন, তাঁদের আবার ব্যায়ামের প্রয়োজন কী? এটা ঠিক। তাঁদের জন্য আলাদা ব্যায়ামের দরকার নেই। কিন্তু আজকাল মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। তরুণেরা হয়তো ঘরে বসে মোবাইলে গেম খেলতে ব্যস্ত। মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী টেবিলে কলম পিষছেন অথবা কম্পিউটার কী–বোর্ডে কাজ করছেন। তাঁদের জন্য প্রতিদিন অন্তত ১৫ থেকে ৩০ মিনিট হালকা ব্যায়াম খুব দরকার। একটু হাঁটা। হাঁটার মধ্যে দু-চার মিনিট হালকা দৌড়। জোরে বুকভরে শ্বাসপ্রশ্বাস। এসব ব্যায়াম খুব কাজে দেয়।

আপনি যদি প্রবীণ হয়ে থাকেন, তাহলে দিনে অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও এই ব্যায়ামগুলো করুন। দেখবেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছেন। অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।

প্রবীণ বয়সে এর চেয়ে বেশি আর কী চাই?

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]