কাঠমান্ডু হয়ে ঢাকা-তিব্বত?

nepal-china
nepal-china

প্রতিটি দেশের কিছু অবকাঠামোগত স্বপ্ন থাকে। এক সময় সেটা অধরা সায়েন্স ফিকশনের মতো মনে হয়। কিন্তু যোগ্য দেশনায়কেরা ক্রমে ক্রমে সেটাকে বাস্তব করে ফেলেন।

তিব্বতের সঙ্গে রেল যোগাযোগ নিয়েও নেপালিদের এ রকম একটা স্বপ্ন আছে। দশকের পর দশক এ নিয়ে গালগল্প হয়েছে। হিমালয়ের কারণে এটা রূপকথার মতোই শোনাত সমাজে। কিন্তু এখন বিষয়টি প্রযুক্তিবিদদের টেবিলে চলে এসেছে। হিমালয়ের নিচ দিয়ে ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে তিব্বত-কাঠমান্ডু রেলরুট নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই সেরেছে চীন। প্রযুক্তিবিদদের ভাষ্য হলো ধারণাটি বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে যতটা খরচ হবে, ততটা লাভজনক হবে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।

রাজনীতিবিদেরা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নেপালকে
কারওই সন্দেহ নেই, অর্থনীতির বিচারে হিমালয়কে পরাজিত করে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা ধারণাতীত ব্যয়সাপেক্ষ হবে। তবে ব্যয় ছাড়াও চ্যালেঞ্জ রয়েছে আরও অনেক। বিশেষ করে খাঁড়া পর্বতমালা এবং তার ভাঁজে ভাঁজে থাকা খরস্রোতা নদী। উপরন্তু, এই অঞ্চলের ভূকম্পন প্রবণতা।

কিন্তু নেপালের বর্তমান সরকারের অনেক প্রতিনিধি ইতিমধ্যে এ পথের রেল যোগাযোগের সম্ভাব্যতা নিয়ে জনগণের কাছে অঙ্গীকার করে চলেছেন। নেপাল স্থলবেষ্টিত দেশ। কাঠমান্ডুবাসী নির্মম ভারতীয় অবরোধের অতীত স্মৃতি ভুলতে পারে না। তাই চীনমুখী যোগাযোগের প্রস্তাব তাদের কাছে বরাবরই অতি জনপ্রিয়। কিন্তু ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের স্বার্থে কে পি ওলির সরকার একই সঙ্গে ভারত-নেপাল রেল যোগাযোগ বিকাশের পরিকল্পনা নিয়েও কাজ করছে। ফলে, এ মুহূর্তে দারুণ উদ্দীপনার ভাসছে নেপাল। রুট সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়াই কাঠমান্ডু থেকে চীন সীমান্তের দিকে জায়গা-জমির দাম বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। কাঠমান্ডুতে তরুণ-তরুণীরা স্বপ্ন দেখছে, একদিন তারা বেইজিং কিংবা নয়াদিল্লি যাবে ট্রেনে চড়ে।

কিন্তু দরিদ্র নেপালের জন্য বিষয়টি সহজ নয়। কেবল সম্পদের অভাবই নয়; অভাব রয়েছে তাদের দক্ষ জনবলেরও। নেপালের রেলওয়ে এখনই ট্রেন ও জনবলের জন্য ভারতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তারপরও দেশটির নেতৃবৃন্দ আগামী পাঁচ বছরে শত শত কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন। তাঁদের এই স্বপ্নে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে বাংলাদেশেরও।

চীনকে বিনিয়োগে বাধ্য করতে চায় কাঠমান্ডু
কাঠমান্ডুর সঙ্গে সরাসরি ট্রেন সার্ভিস গড়তে চীন যে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে, তা এখনো জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু এর ছিটেফোঁটা যতটুকু প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, তিব্বত থেকে রেললাইনটি আসবে সপ্তকোশির শাখা নদী বোতিকোশিকে অনুসরণ করে। এ ক্ষেত্রে নেপালের ল্যাংট্যাংসহ অন্তত দুটি জাতীয় উদ্যানের তলদেশ দিয়ে ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের কথা ভাবা হচ্ছে। অর্থাৎ, রেললাইনের নেপাল অংশের অনেকখানিই থাকবে টানেলের ভেতর। টানেলে ঢোকা ও বের হওয়ার মুখে বসবে স্টেশনগুলো। তবে ভূগর্ভে ভূকম্পন-সংশ্লিষ্ট হিমালয়ের ফল্ট লাইনগুলো এড়াতে গিয়ে প্রস্তাবিত টানেলের নির্মাণপ্রক্রিয়া স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। যেকারণে চীন-নেপাল সীমান্তের কিরাং-রসুয়াগাদি থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত এই রেলপথের মাত্র ১৭০ কিলোমিটারেই খরচ হবে পাঁচ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার। সীমান্তের অপর পারে এই রুটের ছিংহাই-তিব্বত অংশে চীন ইতিমধ্যে নিজ প্রয়োজনে যে রেলপথ গড়ছে, তা ২০২২ নাগাদ নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত চলে আসবে। নেপালের জন্য ভরসার দিক হলো গত এপ্রিলে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ কর্মসূচির দ্বিতীয় সম্মেলনে চীন ৬৪টি প্রধান অবকাঠামোগত প্রকল্পের মধ্যে কাঠমান্ডু-তিব্বত রেলপথকেও রেখেছে।

চীন-নেপাল উভয় দেশের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হিমালয়ের তলদেশ দিয়ে রেলপথ নির্মাণ নেপালের জন্য ঋণ করে করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধ দুরূহ হবে। কারণ, এই পথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে চীন থেকে ওয়াগন ভরে মালামাল এলেও নেপাল থেকে চীনে পাঠানোর মতো পণ্য থাকবে সামান্যই। ইতিমধ্যে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক ব্যাপকভাবে ভারসাম্যহীন। সুতরাং আপাতত প্রকল্পটি চীনের নিজস্ব অনুদানে কিংবা অন্য কোনো সুবিধাজনক শর্তেই কেবল সম্ভব। কেবল ভূরাজনৈতিক স্বার্থেই চীন এ ধরনের বিপুল বিনিয়োগ করতে পারে। নেপাল ঠিক এই সুযোগই নিতে চাইছে। নেপালে ভারতের বিপরীতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে ইচ্ছুক চীনকে বড় বিনিয়োগে বাধ্য করতে চাইছে কে পি ওলির সরকার। তবে এ রকম একটি প্রকল্প কেবল দান-খয়রাতের ব্যাপার হতে পারে না। তাকে কীভাবে লাভজনক করা যায়, সেই পথও খুঁজতে হবে। সম্প্রতি নেপালে চীনের রাষ্ট্রদূত সেটাই জানিয়েছেন সাংবাদিকদের।

কাঠমান্ডু থেকে ঢাকা নয় কেন?
প্রশ্ন হলো, হিমালয় পেরিয়ে তিব্বত থেকে নেপাল পর্যন্ত রেললাইন স্থাপিত হলে সেটা কাঠমান্ডু থেকে ঢাকা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে বাধা কোথায়? বিশেষ করে বাংলাদেশ ও নেপাল উভয়ে যখন চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে ঘোষণা দিয়ে শামিল হয়ে আছে।

ঢাকার সঙ্গে কাঠমান্ডুর সড়কপথে দূরত্ব ১ হাজার ১০৪ কিলোমিটার। বাসে সম্ভাব্য ৩০ ঘণ্টা সময় লাগে এখন। বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের কাঁকরভিটা পর্যন্ত দূরত্ব মাত্র ৫৪ কিলোমিটার। অনেকবার এই পথে বাস যোগাযোগের কথা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, বাস থেকে রেল যোগাযোগই মানানসই হবে। এই পথে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল তিন দেশেই যার যার রেলপথ রয়েছে। শুধু তার সমন্বয় প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সহজেই যুক্ত হতে পারে তিব্বত পর্যন্ত অনন্যসাধারণ সম্ভাব্য এক রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে, যা তার সঙ্গে আগামী দিনের অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের যোগাযোগ সরাসরি করে তুলবে। নেপাল নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশকে এই প্রক্রিয়ায় শামিল করতে আগ্রহী হবে। কারণ, আপাতত চীনে রপ্তানির মতো সামান্য পণ্যই আছে নেপালে। বাংলাদেশের পাট, চামড়া ও খাদ্যপণ্য কাঠমান্ডু হয়ে তিব্বতগামী শূন্য ওয়াগনগুলো ভরতে পারে। চীন এ মুহূর্তে এশিয়ায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় রপ্তানিপণ্য গ্রহণকারী দেশ। কাঠমান্ডু-চীন রেল যোগাযোগ গড়ে উঠলে চীনে পণ্য প্রেরণকারী বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা নেপালেও তাঁদের কারখানা স্থানান্তর করতে পারেন।

সত্য যে ঢাকাকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত যেতে হলে ভারতের সম্মতি লাগবে। কারণ, মাঝের ৫৪ কিলোমিটার পথ তাদের। এর উত্তরে বলা যায়, খোদ ভারতও কাঠমান্ডু পর্যন্ত সরাসরি রেল যোগাযোগ গড়ে তুলতে চাইছে বিহার থেকে বীরগঞ্জ দিয়ে। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতিও রয়েছে। নরেন্দ্র মোদি এই উদ্যোগকে বলছেন হিমালয়কে মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করার আয়োজন। তা ছাড়া নেপাল-ভারত সীমান্তে স্বল্প পরিসরে এখনো রেল যোগাযোগ রয়েছে।

সুতরাং বাংলাদেশকে কাঠমান্ডুর পথে বাধা দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই ভারতের জন্য। বরং ঢাকা-শিলিগুড়ি-কাঠমান্ডু ত্রিদেশীয় রেলরুট হয়ে উঠতে পারে নতুন একটা সম্ভাবনার নাম। বাংলাদেশ যদি তার ভূমিতে আসাম ও ত্রিপুরা যাওয়ার জন্য করিডর-সুবিধা দিতে পারে, তাহলে ট্রেনে নেপাল পৌঁছাতে বাংলাদেশিদেরও ভারতের সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের উচিত এখনই নেপালের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা। কারণ, নেপাল সরকার এ মুহূর্তে ভারত ও চীনের সঙ্গে বোঝাপড়ায় রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কিছুদিন আগে বাজেট পেশকালে দেশটির সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে তিব্বত-কাঠমান্ডু এবং বিহার-কাঠমান্ডু রেল যোগাযোগের অবকাঠামোতে হাত দেওয়া হবে। চীন-ভারত-নেপালের এই রেল যোগাযোগপ্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ঢাকার উপস্থিতিকে সম্প্রসারণের এক বড় সম্ভাবনা; বিশেষত যখন বাংলাদেশের পূর্বমুখী কূটনীতিতে মিয়ানমার প্রায় নিশ্চিত এক দেয়াল হয়ে উঠেছে।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক