শিক্ষকেরা কেন ফুটপাতে?

আজ ফুটপাতে শিক্ষকদের অনশনের একাধিক ছবি
আজ ফুটপাতে শিক্ষকদের অনশনের একাধিক ছবি

আজ বুধবার সকালে প্রেসক্লাবে যাওয়ার পথে পশ্চিম দিকের সড়কের ফুটপাতে দেখি শিক্ষকেরা অনশন করছেন। কেউ শুয়ে আছেন, কেউ বসে। বেশ কয়েকদিন ধরে তাঁরা অনশনে আছেন। বলছেন, আমরণ অনশন।

প্রেসক্লাবের সামনে মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে বলে সেখানে কাউকে সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তারপরও সমাবেশ হচ্ছে। প্রেসক্লাবের মূল ফটকের পূর্ব পাশে বেকার রিকশাচালকেরা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা বলছেন, ‘আমাদের রুটিরুজি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কোথায় যাব?’ আসলে বাংলাদেশে গরিব মানুষের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এরা জীবিকার সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন। কিন্তু শহর থেকেও উচ্ছেদ হতে যাচ্ছেন। ধনীদের যাওয়ার অনেক জায়গা আছে।

প্রেসক্লাবের সামনে বসতে না দেওয়ায় তাঁরা পশ্চিম দিকের সরু ফুটপাতে ফুটপাতে আশ্রয় নিয়েছেন। গরিব শিক্ষকদের মধ্যে এরা আরও গরিব। বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক। বেতন-ভাতার দাবিতে তাঁরা যে ফুটপাতে বসেছেন, এটি তাঁদের জন্য লজ্জার নয়, পুরো জাতির জন্য লজ্জার। শিক্ষকেরা কেন ফুটপাতে বসে অনশন করবেন?

বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতারা জানান, তাঁরা সরকারীকরণের দাবিতে এর আগেও আন্দোলন করেছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এবারে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। যখন অনশনরত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন মাইকে নানা স্লোগান ভেসে আসছিল। শিক্ষকেরা বলেছেন, মানবতার জননী প্রধানমন্ত্রী যেন তাঁদের বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে দেখেন।

অনশন করতে গিয়ে ইতিমধ্যে ৩৫/৪০ জন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁরা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে অনশন করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ তাদের খোঁজ নেননি। যেই শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে থাকার কথা, তাঁরা বেতন-ভাতার জন্য ঢাকার ফুটপাতে আশ্রয় নিয়েছেন। রাতে মশার কামড় খাচ্ছেন। এভাবে আরও কয়েক দিন থাকল হয়তো সবাই অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

আজ ফুটপাতে শিক্ষকদের অনশনের একাধিক ছবি
আজ ফুটপাতে শিক্ষকদের অনশনের একাধিক ছবি

বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. মামুনুর রশিদ খোকন জানান, চার হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণের দাবিতে গত বুধবার থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছেন শিক্ষকেরা। অসুস্থ শিক্ষকদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

অপর এক শিক্ষকনেতা জানান, সরকারীকরণের প্রক্রিয়ার সময় রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম স্থগিত করায় তাঁরা বেতন-ভাতা, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও টিফিন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। বেতন-ভাতা না পেয়ে তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কিন্তু এই শিক্ষকেরা যেসব স্কুলে আছেন, সেসব স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। শিক্ষকদের অনেকের চাকরিতে প্রবেশের বয়স পার হয়ে গেছে। অন্যত্র চাকরির আবেদনের সুযোগ নেই। তাই, বাদ পড়া ৪ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করে শিক্ষকদের দুরবস্থা থেকে মুক্তি দিতে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছেন তাঁরা।

এর আগে গত বছর জানুয়ারি মাসে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা অনশন করেছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির ব্যানারে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। সমিতির সভাপতি মামুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী তাঁদের বিদ্যালয়গুলো শর্ত পূরণ করলেও জাতীয়করণ করা হয়নি। তাঁদের হিসাবে এ ধরনের বিদ্যালয় আছে ৪ হাজার ১৫৯ টি। এগুলোতে শিক্ষক আছেন ১৬ হাজার ৩৩৬ জন।

এই শিক্ষকেরা যোগ্য কি যোগ্য নন, সেই বিতর্কে আমরা যেতে চাই না। তাঁরা আমাদের শিশুদের শিক্ষা দিচ্ছেন। সরকার যে শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ বলে দাবি করছে, তাতে এই পেটে ভাত না থাকা শিক্ষকদেরও অবদান আছে। সেই অবদানকে সরকার অগ্রাহ্য করতে পারে না। আমাদের সংবিধানের মূলনীতি অংশে ১৭ অনুচ্ছেদের ক উপধারায় আছে: ‘একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’

কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও সরকার অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে পারেনি বলেই প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-ভাতার জন্য ফুটপাতে অনশন করতে হচ্ছে। সরকার সংবিধান অনুযায়ী অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করুক। তাহলে শিক্ষাদানকারী অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন-ভাতার জন্য আন্দোলন করতে হবে না। তাঁদের দায়িত্বও স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরকারের ওপর ন্যস্ত হবে। যে শিক্ষকেরা আমাদের শিশুদের পাঠদান করছেন, নিরক্ষরতা দূর করছেন, তাঁদের সম্পর্কে সরকার উদাসীন থাকতে পারে না।

সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৪ চার হাজার ১৫৯টি। আর এগুলোতে শিক্ষক আছেন ১৬ হাজার ৩৩৬ জন। সরকার ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে কৃতিত্ব দাবি করে। কিন্তু সেই ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেটে কেন বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ থাকবে না? গত বছর বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকেরাও প্রেসক্লাবের সামনে অনশন ও অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন। সে সময়ে সরকার তাঁদের দাবি মেনে নিয়েছিল। এবারের বাজেটেও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এমপিওভুক্তির জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তাহলে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকেরা কেন বঞ্চিত হবেন? তাঁদের অনশনের এক সপ্তাহ পার হওয়ার পরও কেন তবে সরকার চুপ আছে?

অবিলম্বে বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি মেনে নিন। জাতিকে লজ্জা থেকে রক্ষা করুন।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক