চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা

অল্প বৃষ্টি বা জোয়ারে চট্টগ্রাম মহানগরীতে জলাবদ্ধতা ঘটে এবং মানুষ কষ্টে ভোগে, এমন খবরে কোনো বিস্ময় নেই। আশির দশক থেকে এই জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে বহু ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও এর কোনোটিরই সুষ্ঠু বাস্তবায়ন মানুষ দেখেনি। এর মূল কারণ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারার সীমাবদ্ধতা। ১৯৯৫ সালের ইউএনডিপির অর্থায়নে প্রণীত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানটির বাস্তবায়ন জলাবদ্ধতার সংকট মেটানোর চাবিকাঠি। অথচ সিটি নাকি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), কে তা বাস্তবায়ন করবে, এই ঠেলাঠেলিতেই প্ল্যানটি লালফিতা বন্দী। 

২০১৪ সালে বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী খাল খননে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকল্প হিসেবে একনেকে পাস হলেও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের অভাবে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সবশেষ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত মেয়রের নেতৃত্বাধীন সিটি করপোরেশনকে পাশ কাটিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে দিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অতীতে আওয়ামী লীগ সরকার ও বিএনপির মেয়র থাকায় চট্টগ্রামবাসী দুর্ভোগ সয়েছে। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য, এখন আওয়ামী লীগের সরকার ও মেয়র দুটি একসঙ্গে থাকলেও মেয়র সরকারের সুনজরে নেই বলেই অনেকে মনে করেন। মহানগরীর উন্নয়নে এর নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার সংকট নিরসনের প্রশ্নটি প্রধানত কর্ণফুলী নদী, নগরীর কয়েক ডজন খাল দখলমুক্ত করা ও খনন এবং পাহাড় কাটা বন্ধের সঙ্গে যুক্ত। স্বাধীনতার আগে ৭০টি খাল ছিল। ২০টি লুপ্ত হওয়ার পরে ৫৮টি টিকে আছে। কিন্তু কী কারণে বর্তমান মেগা প্রকল্পের অধীনে ২২টিকে বাদ দিয়ে ৩৬টি খাল বেছে নেওয়া হয়েছে, তা অস্পষ্ট। ওই প্রকল্পের অধীনে কাজ শুরু হওয়ার গত প্রায় ১৫ মাসে ১৩টি খালে খননকাজ শেষ হয়েছে। এসব খালে দেড় হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে। সম্প্রতি তা অপসারণে সেনাবাহিনীর সহায়তায় সিডিএ অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু এসব খাল ভবিষ্যতে দখলমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটিও একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। তাই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নই শেষ কথা নয়। 

এ থেকে কার্যকর সুফল পেতে হলে এগুলোর সার্বক্ষণিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন যে এই কাজ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নয়, এতে অভিজ্ঞ এবং যার এটা করা সাজে সে হলো সিটি করপোরেশন। অথচ সিটি করপোরেশনকে এর সঙ্গে একদম রাখা হয়নি। এর আগে আমরা দেখেছি, বন্দর কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করেই মহেশ খালের ভেতরে বাঁধ তৈরি করল। এতে জলাবদ্ধতার সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করলে এলাকাবাসী সেই বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল। সুতরাং শুধু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন নয়, এর ফলে চট্টগ্রামবাসী জলাবদ্ধতার সংকট থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি পাবে, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে। 

আমরা মনে করি, এই প্রকল্পের সঙ্গে সিটি করপোরেশনকে যথাযথভাবে সম্পৃক্ত করা জরুরি। দৃশ্যপটে ইতিমধ্যে ওয়াসাকেও দেখা যাচ্ছে। সুতরাং সিটি করপোরেশন, সিডিএ এবং ওয়াসার মতো সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা চলতে থাকলে মেগা প্রকল্প থেকে যথাযথ সুফল মিলবে না, এবং তা হবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। 

হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায় মেনে প্রতিটি খাল তার মূল অবয়ব ও আয়তন অনুযায়ী পুনরুদ্ধার, সীমানাখুঁটি বসানো ও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এবং কর্ণফুলীর নাব্যতা সুরক্ষায় নদী রক্ষা কমিশনকে অবশ্যই যুক্ত করতে হবে। এটা এখন আইনি বাধ্যবাধকতা। আর পাহাড় কাটার ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দরকার। কারণ, পাহাড় কাটা চলতে থাকলে বালু এসে খাল ভরে দেবে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্ভব সব রকম সতর্কতা ও সুরক্ষা প্রত্যাশিত।