শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকাল

সরকার আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে সফলতা দাবি করছে, শিক্ষার হার তার অন্যতম। সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সাক্ষরতার হার ৭৩ শতাংশে পৌঁছেছে; যদিও বেসরকারি সংস্থার হিসাবে সাক্ষরতার হার আরও কম।

কিন্তু বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানুষের গড় শিক্ষাকাল মাত্র ৫ দশমিক ১ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত মোট শিক্ষাবর্ষ ১৭ বছর এবং মাধ্যমিক পর্যন্ত ১১ বছর। সেখানে ৫ দশমিক ১ বছরে একজন শিক্ষার্থী কী শিক্ষা পায়, কতটা নিজেকে গড়ে তুলতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। ভারতে শিক্ষার্থীর গড় শিক্ষাকাল ৫ দশমিক ৮, শ্রীলঙ্কায় ১০ দশমিক ৯, মালয়েশিয়ায় ১০ দশমিক ১ ও ভিয়েতনামে ৭ দশমিক ৮ বছর।

একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাকাল ৫ দশমিক ১ বছর হলে খুব বেশি হলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত উত্তীর্ণ হতে পারে, যা দ্বারা কোনোভাবে নিজেকে যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায় না। একজন মানুষকে যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক হয়ে উঠতে কমপক্ষে ৮–৯ বছর পড়াশোনা করা প্রয়োজন। এ কারণে স্বাধীনতার পর গঠিত কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার সুপারিশ করেছিল। পরবর্তীকালে কোনো সরকার সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করার প্রয়োজন বোধ করেনি; যদিও ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার অঙ্গীকার ছিল। আমাদের অনেক অঙ্গীকারই কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই–এর মতো।

যেকোনো দেশের মানবসম্পদের মান নির্ভর করে তার শিক্ষার মানের ওপর। পশ্চিমের ও পুবের যেসব দেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করেছে, সেসব দেশের শিক্ষার হার যেমন বেশি, তেমনি শিক্ষাকালও। মানবসম্পদ উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ লক্ষণীয়ভাবে এগিয়ে থাকলেও শিক্ষার হার ও মানে পিছিয়ে আছে।

শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাই শিক্ষাকে মানবসম্পদ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, অধিক মানবসম্পদ উন্নয়নের দেশগুলোয় গড় শিক্ষাকাল ১৩ থেকে ১৫ বছর। মধ্যম মানের দেশগুলোয় এ সময় ৮ থেকে ১০ বছর। সে ক্ষেত্রে ৫ দশমিক ১ শিক্ষাকাল নিয়ে বাংলাদেশ খুব বেশি এগোতে পারবে না। তারপরও আমাদের শিক্ষার মানও প্রশ্নবিদ্ধ।

চলতি বছর প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮: লার্নিং টু রিয়েলাইজ এডুকেশনস প্রমিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না। আবার পঞ্চম শ্রেণির ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতের সহজ বিষয়েও ন্যূনতম স্কোর করতে পারছে না।

আর্লি চাইল্ডহোল্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, নিম্নমানের শিক্ষকতা, বিদ্যালয়ের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা খাতে সরকারের কম বরাদ্দকে বাংলাদেশের শিক্ষাপদ্ধতির দুর্বলতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) প্রকাশিত শিক্ষা তথ্য প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকে ভর্তি হওয়া শিশুদের ২০ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। মাধ্যমিকে গিয়ে ঝরে পড়ার এ হার দাঁড়ায় ৪০ শতাংশেরও বেশি।

এ অবস্থায় শিক্ষার হার নিয়ে কৃতিত্ব জাহির করা বা আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। দেশের প্রতিটি নারী-পুরুষকে যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত
করে তুলতে হবেই। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, হার বাড়িয়ে কোনো কাজ হবে না, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। কেননা, শিক্ষার
বর্ধিত হার দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলবে না, যদি সেটিকে সত্যিকার শিক্ষায় রূপ দেওয়া না যায়।