হাতের কাছে ভরা কলস, তৃষ্ণা মেটে না

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটির কথা মনে আছে? রাজার পায়ে যাতে ধুলা না লাগে, তার জন্য কত পদ্ধতিই না উদ্ভাবন করেছিল রাজকর্মচারীরা। ঝেঁটিয়ে ধুলা বিদায় করতে গিয়ে জগৎ-সংসারই ধুলায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল তারা। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল পুরো দেশটাকে চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া যায় কি না। শেষে সামান্য একজন চর্মকার এসে পরামর্শ দিয়েছিল, এত কিছু না করে রাজার পা দুটি চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে দিলেই তো হয়। এভাবেই রাজার পরিধানের জুতা আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে শ্লেষাত্মক কবিতাটিতে উল্লেখ করেছিলেন কবি।

কবিতাটির কথা নতুন করে মনে পড়ল সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চলে ভয়াবহ পানিসংকটের বাস্তবতা দেখে। ইস্পাত, ঢেউটিন, সিমেন্ট, সুতা, কাচ, ওষুধ, এলপিজি, অক্সিজেন, পাটসহ প্রায় ৩৮৫টি শিল্পকারখানা আছে এই অঞ্চলে। এর মধ্যে কিছু কিছু শিল্পকারখানা দেশের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ ও বহুল কর্মসংস্থানের জন্য পরিচিত। দীর্ঘকাল ধরে এখানে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার দুটি প্রধান কারণ হচ্ছে ১. চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ অঞ্চলের দূরত্ব মাত্র ২৮ কিলোমিটার ও ২. ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশেই এর অবস্থান। এ কারণেই শতবর্ষ আগে থেকে এখানে গড়ে উঠেছে শিল্পাঞ্চল।

একসময় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপ্রতুলতা নিয়ে অভিযোগ করতেন শিল্পোদ্যোক্তারা। কিন্তু বিদ্যুৎ নিয়ে এখন আর কোনো অভিযোগ নেই। এলএনজি আমদানির ফলে গ্যাস সমস্যারও অনেকটাই সমাধান হয়েছে। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় সংকটটির নাম পানি। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সালে যে জিওলজিক্যাল সার্ভে করা হয়েছিল, তাতে দেখা যায়, এখানে ভূগর্ভের পানির সংস্থান খুবই নাজুক। এতকাল আগের জরিপেই যদি এই তথ্য উঠে আসে, তাহলে এর মধ্যে আরও অনেক শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার পর অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা সহজেই অনুমেয়।

গত পাঁচ-ছয় বছরে এখানে পানির সংকট এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা শিল্পকারখানাগুলোর উৎপাদন পড়েছে হুমকির মুখে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং জলাভূমি না থাকায় এই সমস্যা উত্তরোত্তর প্রকট হচ্ছে। বারো শ থেকে তেরো শ ফুট গভীরেও পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের অন্যান্য শিল্পাঞ্চলে দু-তিনটি গভীর নলকূপ বসিয়ে পানির চাহিদা মিটছে, কিন্তু সীতাকুণ্ডে চল্লিশ-পঞ্চাশটি গভীর নলকূপ বসিয়েও এই চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।

অন্যদিকে আবার এই শিল্পকারখানাগুলোর পানি উত্তোলনের কারণে শুষ্ক মৌসুমে এখানকার গৃহস্থালির নলকূপগুলোতেও পানি পাওয়া যায় না। সব মিলিয়ে পানির জন্য একধরনের হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলে। শিল্পাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইস্পাত কারখানাগুলো। সারা দেশে যত ইস্পাত ব্যবহৃত হয়, তার ৬০ শতাংশেরই জোগান দেয় সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন কারখানা। কারণ, এখানেই রয়েছে আবুল খায়ের, বিএসআরএম, জিপিএইচ, পিএইচপি, কেএসআরএম, টিকে গ্রুপ ও কেডিএসের মতো বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কারখানা।

এখানকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব সম্পর্কে পাঠকদের অবগতির জন্য আপাতত একটি তথ্য উল্লেখ করতে চাই। জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড ও অস্ট্রিয়ার প্রাইমেটাল টেকনোলজিস জিএমবিএইচ যৌথভাবে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে গড়ে তুলছে বিশ্বমানের প্রযুক্তি কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস-সংবলিত ইস্পাত কারখানা। এর উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হবে শিগগির। এতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে প্রায় ৮০ কোটি টাকা। কারখানাটি উৎপাদনে গেলে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে চার শ থেকে পাঁচ শ কোটি টাকা। এই নতুন কারখানার জন্য দৈনিক ৬০ লাখ লিটার পানির প্রয়োজন পড়বে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

সীতাকুণ্ডের অদূরেই গড়ে তোলা হয়েছে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল। প্রচুর পানির প্রয়োজন পড়বে সেখানেও। চট্টগ্রামের মোহরা থেকে পাইপলাইনে সীতাকুণ্ড হয়ে মিরসরাই পর্যন্ত পানি সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। নিঃসন্দেহে এটা খুবই কার্যকর উদ্যোগ। কিন্তু সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে তিন বছরের বেশি। এই মধ্যবর্তী সময়টাতে পানির চাহিদা কীভাবে মেটানো যাবে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংকটের বিষয়টি তুলে ধরে গত বছর থেকেই স্থানীয় সাংসদ, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, শিল্প মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মহলকে চিঠি দিয়ে সুরাহার দাবি জানিয়েছেন উদ্যোক্তা ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের নেতারা। আপাতত বিকল্প হিসেবে সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চলে সরকারি উদ্যোগে জলাধার নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে শিল্পোদ্যোক্তা ও চেম্বারের পক্ষ থেকে। শুরুতেই ‘জুতা আবিষ্কার’-এর কবিতাটি উল্লেখ করেছিলাম এই জলাধার নির্মাণের সহজ প্রক্রিয়াটি প্রসঙ্গে। সীতাকুণ্ড পাহাড়ি অঞ্চল। এখানকার পাহাড়ি ঝরনা বা ছড়া থেকে নেমে আসা পানির স্রোত চলে যায় বঙ্গোপসাগরে। অথচ জলাধার নির্মাণ করে বা সাময়িক বাঁধ দিয়ে এই পানি ব্যবহার করার সুযোগটি ঝুলে আছে সরকারি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দীর্ঘসূত্রতার কারণে। ভূ-উপরিভাগের পানি (সারফেস ওয়াটার) ব্যবহারের কথাটি আজকাল সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে পরিবেশবিদ পর্যন্ত প্রায় সবাই বলে থাকেন, অথচ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এখানে কেন এই পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে না, বোধগম্য নয়।

গত এপ্রিল মাসে স্থানীয় সাংসদ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর কাছে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, পাহাড়ের খাল-খন্দক-নালা-ছড়াগুলোতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে এ অঞ্চলের পানির চাহিদা জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। একইভাবে জলাধার তৈরি করা হলে শিল্পকারখানায় পানি সরবরাহ ছাড়াও এলাকাবাসীর জন্য সুপেয় পানির জোগান দেওয়া যাবে।

পাহাড়ি ছড়ার অব্যবহৃত পানি সংরক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব জলাধার নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল গত এপ্রিল মাসে। কমিটির পরবর্তী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের কথা ছিল। কিন্তু তিন মাস অতিক্রান্ত হলেও সেই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। চেম্বার নেতারা থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত সবাই যখন একযোগে দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে সম্ভাব্যতা জরিপের প্রতিবেদন দাখিল ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারটি প্রলম্বিত হওয়ায় কপালে ভাঁজ পড়ছে বিনিয়োগকারীদের। হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা শিল্পে প্রতিটি মুহূর্তের অপচয় যে আর্থিক ক্ষতির সমান নিক্তিতে মাপতে হচ্ছে—এই বোধোদয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হবে কবে?

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]