পাগলা রাজা, কমেডিয়ান প্রেসিডেন্ট

গত মাসে ব্যাংকক গিয়েছি একটা কনফারেন্সে। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যাচ্ছি। আমার অভ্যাসমতো ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলাম। থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা ভুমিবলকে ভালোবাসত মানুষ। কেমন ছিলেন তিনি? গুড গুড! নতুন রাজা মাহা কেমন? কয়েকবার প্রশ্ন করার পর অনুচ্চ স্বরে বলেন: নট গুড! কেন নট গুড, এ নিয়ে আর কথা বলতে রাজি হলেন না ট্যাক্সিচালক।

থাইল্যান্ডের নতুন রাজাকে নিয়ে আমার আগ্রহের কারণ ছিল। তিন বছর আগে ভুমিবলের মৃত্যুর পরই মাহা ভাজিরালংকর্ন রাজা হিসেবে ঘোষিত হন, এ বছর ৪ মে রাজা হিসেবে তাঁর আনুষ্ঠানিক অভিষেক হয়। এ সময় তাঁকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন ফিচার পড়ে হতবাক হয়ে যাই আমি।

মাহা রাজা হওয়ার আগে পরিচিত ছিলেন ভোগবিলাসে মত্ত খামখেয়ালি রাজপুত্র হিসেবে। ২০১৬ সালে রাজা ঘোষিত হওয়ার পর তাঁর বিভিন্ন খামখেয়ালির আরও বেশি মূল্য দিতে হয় দেশটিকে। অভিষেকের কিছুদিন আগে তিনি যাঁকে বিয়ে করেন, তাঁর সেই চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন একজন বিমানবালা। প্রেমে পড়ার পর তিনি তাঁকে একবারে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদবি প্রদান করেন এবং বানিয়ে দেন রাজকীয় নিরাপত্তা বাহিনীর উপপ্রধান। এর আগে ক্রাউন প্রিন্স থাকাকালে তিনি তাঁর অতি আদরের পোষা কুকুর ‘ফু-ফু’কে বানিয়ে দেন বিমানবাহিনীর এয়ার চিফ মার্শাল!

পুরোপুরি পাগলাটে ব্যাপার-স্যাপার। কিন্তু এই ‘পাগলকে’ নিয়ে একটা কথা বলার অধিকার নেই থাইল্যান্ডের মানুষের। ‘লেসে ম্যাজেস্টি’ আইনে তাঁর কোনো সমালোচনা কঠোর শাস্তির অপরাধ সেখানে। জবাবদিহি না থাকলে কোন পর্যায়ে চলে যান শাসকেরা, তার একটি বড় উদাহরণ থাইল্যান্ডের ‘সীমিত ক্ষমতার’ রাজা।

বাইরের পৃথিবীতে একই সময়ের ভালো উদাহরণও আছে। ইউক্রেনের নতুন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি এমন উদাহরণ তৈরি করে আলোচিত হয়েছেন সারা বিশ্বে। এ বছর মে মাসে তিনি কমেডিয়ান (কৌতুক অভিনেতা) থেকে একবারে দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়ে তাক লাগিয়ে দেন চারদিকে। কিন্তু আমাদের দেশে তিনি আলোচিত হন তাঁর একটি নির্দেশের কারণে। নির্দেশটি ছিল, সরকারি দপ্তরে প্রেসিডেন্ট, অর্থাৎ তাঁর কোনো ছবি থাকবে না এখন থেকে। ছবি থাকবে সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানদের। তাঁর ব্যাখ্যা হচ্ছে, এসব ছবি সামনে থাকলে বরং বেশি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন তাঁরা। সত্যি তা হবে কি না, সেটি গবেষণার বিষয়। কিন্তু নতুনভাবে চিন্তা করতে পারেন কোনো শাসক, সম্মান করতে পারেন তাঁর নাগরিকদের মর্যাদাবোধকে, এ সংবাদের সর্বজনীন আবেদন ছিল বলেই আমরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম তা ফেসবুকে শেয়ার করতে!

‘পাগলা’ রাজা আর ‘কমেডিয়ান’ প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আরেকটু আলোচনার প্রয়োজন আছে। কারণ, তাঁদের ঘিরে ঘটা বিভিন্ন ঘটনায় প্রতিফলিত হচ্ছে পৃথিবীর বহু অঞ্চলের মানুষের সংকট আর সম্ভাবনা দুটোই।

২.

থাইল্যান্ডে রাজার সম্মান রক্ষার আইনটি রয়েছে দেশটির ১৯০৬ সালের ক্রিমিনাল কোডে। সেখানে বলা হয়েছে, কেউ রাজা, রানি ও রাজার উত্তরাধিকারীকে মানহানি বা অসম্মান করলে তাঁর তিন থেকে পনেরো বছরের জেল হবে। কিন্তু কিসে রাজার অসম্মান হবে, সেটাই সেখানে ব্যাখ্যা করা হয়নি। বরং এই আইনে রাজার অসম্মান হয়েছে, এ অভিযোগে যেকোনো ব্যক্তিকে মামলা করার অধিকার দিয়ে এবং অপরাধটিকে জামিন অযোগ্য হিসেবে বর্ণনা করে এর অপব্যবহারের অবাধ সুযোগ রাখা হয়। ফলে থাইল্যান্ডে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনী, রাজনীতিবিদ ও বড় ব্যবসায়ী চক্রের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব বা আঁতাত হয় প্রায়ই, তার একটি খুঁটি হিসেবে সহজে ব্যবহার করা সম্ভব হয় এটিকে।

২০১২ সালে থাইল্যান্ডে পুনরায় ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী তা-ই করা শুরু করে। অভিযোগ রয়েছে যে এরপরই রাজার সম্মান রক্ষার আইনটি তারা ব্যাপকভাবে প্রয়োগ শুরু করে মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের কাজে। পরের পাঁচ বছরে ১৩৪টি মামলায় ১৭৮ জনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনা হয় এবং এর মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ শাস্তি এড়াতে সক্ষম হয়। দুজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তার আনা মামলায় এই আইনে ২০১৭ সালে ৮৫ বছর বয়স্ক একজন প্রসিদ্ধ ভিন্নমতাবলম্বীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। তাঁর অপরাধ, তিনি ২০১৪ সালে একটি বক্তৃতায় ১৬ শতাব্দীর এক থাই রাজা একটি দ্বন্দ্বযুদ্ধ আসলেই করেছিলেন কি না, এ প্রশ্ন তুলেছিলেন!

এই আইনের অপব্যবহার হতো আগেও। দেড় শ বছর আগের এক সাবেক রাজার আমলে দাসপ্রথা নিয়ে কথা বলার দায়ে ২০০৭ সালে এই আইনে শাস্তি পান একজন রাজনীতিবিদ। কারণ, সাবেক রাজাদের নিয়ে অবমাননাকর কিছু বলা মানেও বর্তমান রাজতন্ত্রকে ক্ষতি করা! এই রায় দেন স্বয়ং সুপ্রিম কোর্ট!

সিংহাসনে মাহার উত্তরাধিকারী হিসেবে নিশ্চিত হওয়ার পর আইনটির প্রয়োগ শুরু হয় সরাসরি তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে। যেমন ২০১৪ সালে মাহা তাঁর তৃতীয় স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার পরপরই তাঁর মা-বাবাসহ ৯ জন নিকটাত্মীয় এই আইনে গ্রেপ্তার হন, একজন জিজ্ঞাসাবাদের সময় জানালা দিয়ে পড়ে রহস্যজনকভাবে নিহত হন। মাহার অসম্মানের জন্য গ্রেপ্তার হয়ে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু ঘটে পুলিশ, বডিগার্ডসহ আরও কয়েকজনের। গত এক বছরে রাজার প্রতি অসম্মানজনক ফেসবুক পোস্টে শুধু লাইক দেওয়ার কারণেই বিচারের মুখোমুখি হন বেশ কয়েকজন।

জবাবদিহিহীন ব্যক্তিপূজাকেন্দ্রিক শাসন কত ভয়ংকর, এর উদাহরণ শুধু উত্তর কোরিয়ার মতো বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন দেশ নয়, এমন উদাহরণ আছে থাইল্যান্ডের মতো বহু তথাকথিত ‘মুক্ত সমাজে’ও।

৩.

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের গল্পটা ভিন্ন। তিনি সাধারণ পরিবার থেকে আসা একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মানুষ তাঁকে চিনত একজন কমেডিয়ান হিসেবে। ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’ নামক কমেডিতে তিনি স্কুলশিক্ষক থেকে ঘটনাক্রমে প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া একটি ভূমিকায় সরস অভিনয় করে নাম করেছিলেন। রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাত এবং পূর্ব ইউক্রেনে রাশান বংশভুক্তদের বিদ্রোহে জর্জরিত ইউক্রেনে হঠাৎ করেই তিনি ঘোষণা দিয়ে বসেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর। রাজনৈতিক ন্যূনতম অভিজ্ঞতা নেই, এমন এই প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণাও ছিল প্রায় সম্পূর্ণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর। নির্বাচনের ফলাফলে তাঁর কমেডির চিত্রনাট্য বাস্তব হয়ে ওঠে নির্বাচনে তাঁর বিপুল ব্যবধানে জয়ের মাধ্যমে।

৪১ বছরের এই অভিনেতা ক্ষমতায় এসেই চিরাচরিত শাসকদের চেয়ে তাঁর ভিন্নতা স্পষ্ট করে দেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর ২০ মের ভাষণে তিনি সরকারি দপ্তরে তাঁর ছবি না রাখার অনুরোধ জানান। ‘আমি সত্যিই চাই না আমার ছবি থাকুক আপনাদের দপ্তরে। কারণ, প্রেসিডেন্ট কোনো আইকন বা আইডল নন। বরং আপনাদের সন্তানদের ছবি দপ্তরে ঝুলিয়ে রাখুন এবং প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সময় তাদের দিকে তাকান।’ তিনি নির্বাচনে দাঁড়ানোর সময় বলতেন, মানুষ একটি ‘মানবীয় মুখ’ চায় তাদের প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি সেই মানবীয় মুখ হয়ে উঠেছেন দ্রুত। অভিষেক ভাষণে তিনি সৎ এবং স্বচ্ছ একটি সরকার ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেন। শাসন করা নয়, যাদের কাজ হবে জনগণের সেবা করা।

তাঁর কাজ সহজ হবে না। অভিজাততন্ত্র ও বড় ব্যবসায়ীরা সক্রিয় ইউক্রেনের শাসনকাঠামোতে। আছে দুর্নীতি, বেকারত্ব আর রাশিয়ার সঙ্গে
সংঘাতের সংকটও। আর তাঁর অনভিজ্ঞতা। তিনি নিজেই তাঁর অনভিজ্ঞতার কথা বারবার অকপটে বলেন। কিন্তু এটি ঢাকতে তিনি মন্ত্রিসভায় বেছে নিয়েছেন চৌকস ব্যক্তিদের।

তিনি তাই বলে সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। ইউক্রেনের এক বিতর্কিত কোটিপতির সঙ্গে তাঁর সখ্য বা মন্ত্রিসভায় তাঁর কমেডির লেখকের অতি
সাম্প্রতিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সমালোচনা আছে। কিন্তু তিনি বারবার এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি দেশ চালাবেন শিখে শিখে, মানুষের সম্মতি নিয়ে এবং সেবকের মনোভাব নিয়ে।

সাধারণ কথা। কিন্তু কী প্রচণ্ডভাবেই না এটাই আশা করে পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ। জেলেনস্কির মতো উত্থান সম্ভব নয় পৃথিবীর বহু অনুন্নত গণতন্ত্রে। নির্বাচনই সঠিকভাবে হয় না সেখানে। হলে কে জানে জেলেনস্কিরাই হয়তো বিজয়ী হতেন সেখানে।

মাহা যদি হন একটা কণ্ঠরুদ্ধ সমাজের পাপ, জেলেনস্কি তাহলে মুক্ত সমাজের অর্জন। তাঁদের গল্প তাই প্রাসঙ্গিক পৃথিবীর বহু দেশে।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক