স্তালিনবাদকে যাঁরা জিন্দাবাদ দিচ্ছেন

স্তালিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমপক্ষে দুই কোটি মানুষ নিহত হয়েছেন
স্তালিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমপক্ষে দুই কোটি মানুষ নিহত হয়েছেন

একসময় বলা হতো, মস্কোতে বৃষ্টি হলে আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা বৃষ্টির ছিটেফোঁটা না থাকলেও ছাতা মেলে ধরেন। ভেবেছিলাম, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ছাতা ধরা বন্ধ হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় স্তালিন নামের এক নাটক দেখে একদল স্তালিনপন্থী যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাতে বুঝলাম, কয়লার ময়লা ধোয়া সহজ নয়। খোদ রাশিয়ায় এবং স্তালিনের জন্মস্থান জর্জিয়ায় মহাপরাক্রমশালী সেই কমিউনিস্ট নেতার প্রায় সব মূর্তি উপড়ে ফেলা হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের বুকে সে মূর্তি এখনো বহাল তবিয়তে পোঁতা রয়েছে।

স্তালিন—এবং কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন—মানবতার বিরুদ্ধে কী অপরাধ করেছে, তার ক্যাটালগ এখানে পুনরুল্লেখ অবান্তর। স্তালিনের মৃত্যুর পর—বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর—রুশরাই সে কাজটি করেছে। অবশ্য সে কাজ শুরু হয়েছে আরও অনেক আগে, গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে। কোনো মার্কিন দালালের হাতে নয়, খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নিকিতা খ্রুশ্চেভের হাতে। ১৯৫৬ সালে পার্টির ২০তম কংগ্রেসে সে সত্য প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। বিস্মিত দলীয় সদস্যদের সামনে খ্রুশ্চেভ ভেঙে বলেছিলেন, স্তালিনের হাতে তাঁর দেশের মানুষ কী ভয়াবহ নিগ্রহের শিকার হয়েছে। দলের সবাই নীরবে সে নিগ্রহ স্বীকার করেছিল, ফলে তারাও কার্যত মানবতার বিরুদ্ধে সে অপরাধের অংশীদার। খ্রুশ্চেভ প্রশ্ন রেখেছিলেন:

‘যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, যাঁদের হত্যা করা হয়েছিল, এখন তাঁদের ব্যাপারে আমরা কী করব? যাঁরা সে অপরাধের শিকার, আমরা এখন জানি, তাঁরা সবাই নিরপরাধ ছিলেন। আমাদের কাছে বিতর্কোর্ধ্ব প্রমাণ রয়েছে, তাঁরা কেউই জনগণের শত্রু ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন সৎ, দলের প্রতি অনুগত নারী ও পুরুষ। আমরা তো ভালো করেই জানি কী ভয়াবহ নির্যাতনের রাজত্ব ছিল সেটি, দলের নেতৃত্ব কেমন স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার করেছেন। ভয়াবহ সে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর কিছুই হয়নি, কীভাবে এমন ভান করে থাকতে পারি আমরা? না, কী হয়েছিল সে কথা আমাদেরই বলতে হবে।’

এ কথা এখন প্রমাণযোগ্য যে স্তালিনের হাতে, সোভিয়েত পুলিশি রাষ্ট্রের হাতে, কমপক্ষে দুই কোটি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর একটা বড় অংশ নিহত হয়েছেন ক্ষুধায়, ইউক্রেনে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরোপিত দুর্ভিক্ষে। অন্যরা নিশ্চিহ্ন হয়েছেন ফায়ারিং স্কোয়াডে, সাইবেরিয়ার গুলাগে। বিপ্লবের যাঁরা ছিলেন রূপকার, এই বিপ্লবের সেরা সন্তান, তাঁরা নিহত হয়েছিলেন স্তালিনের হাতে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কিরভ, কামিনিয়েফ, জিনোভিয়েফ ও বুখারিন। ট্রটস্কি, যাঁর নেতৃত্বে পেত্রোগ্রাদে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, তাঁকে দেশ থেকে বিতাড়ন করেও স্তালিন সন্তুষ্ট হননি, ভাড়াটে আততায়ী দিয়ে তাঁকে খুন করা হয়। মেক্সিকোতে সেই খুনিকে ২০ বছরের সাজা দেওয়া হয়, আর মস্কোতে স্তালিনের নির্দেশে তাঁকে লেনিন পুরস্কার দেওয়া হয়। স্তালিনের হাতে নিহত ব্যক্তিদের একজন ছিলেন বাংলাদেশের গুলাম আম্বিয়া লোহানী, বিশ্বমানবতার মুক্তিতে হাত লাগানোর জন্য মস্কো এসেছিলেন রুশ বিপ্লবের পরপর। স্তালিনের নির্দেশে বিদেশি চর হিসেবে তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মস্কোর মহাফেজখানা খুলে দিলে যেসব নথিপত্র বেরিয়ে এসেছে, তাতে দেখা যায়, অন্ততপক্ষে ৩৬২টি ‘হত্যা নির্দেশ’সূচক তালিকা রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটির নিচে স্তালিনের স্বাক্ষর রয়েছে। এ কথা ঠিক, স্তালিন নিজ হাতে এসব খুন করেননি, কিন্তু নির্দেশটি এসেছে তাঁর কাছ থেকে। তাঁকে সে কাজে মদদ দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। আমরা স্তালিনের ডান হাত গোপন পুলিশপ্রধান লাভরেন্তি বেরিয়ার কথা শুনেছি। কিন্তু একা বেরিয়া নন, কমিউনিস্ট পার্টির ছোট-বড় সব ধরনের নেতাই সাগ্রহে স্তালিনের ফাঁসুড়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন এজভ, কাগানভিচ, মিকোয়ান এবং স্বয়ং খ্রুশ্চেভ।

স্তালিনই পৃথিবীর একমাত্র অথবা শেষ হত্যাকারী নন; ইতিহাস মাওকে দেখেছে, দেখেছে পলপট ও ইয়াহিয়াকে। আমাদের দায়িত্ব এঁদের ভুলে না যাওয়া, এঁদের ভুলতে না দেওয়া। লেনিনের নিকট-বন্ধু ও রুশ বিপ্লবের অন্যতম স্থপতি নিকোলাই বুখারিন, ১৯৩৮ সালে স্তালিনের নির্দেশে নিহত হওয়ার আগে, তাঁর স্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়ে গিয়েছিলেন। পার্টি নেতাদের উদ্দেশে লেখা সে চিঠি, স্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন চিঠিটি মুখস্থ করার পর তা যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। তাঁর স্ত্রী এ এম লারিনা ১৯৬১ সালে নিজে স্তালিনের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সে চিঠির কথা দলের নেতাদের জানান। তাতে বুখারিন লিখেছিলেন,

‘আমি চলে যাচ্ছি। আমি নরকসম মধ্যযুগীয় এক শাসনযন্ত্রের শিকার, এই শাসনযন্ত্র এখন এতটাই ক্ষমতাবান যে তার সামনে আমরা সবাই ক্ষমতাহীন। দলের নেতাদের কাছে আমি আবেদন করছি, আজ হোক অথবা কাল, আপনারা ইতিহাসের সাক্ষ্য গ্রহণ করুন। আমি নিশ্চিত, একদিন না একদিন প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে, আমার গায়ে যে কলঙ্ক লেপে দেওয়া হলো, তা মুছে যাবে। আমি কখনো বিশ্বাসঘাতক ছিলাম না। লেনিনের জন্য আমি যেকোনো সময়ে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম। প্রিয় কমরেডরা, মনে রাখবেন, একদিন আপনারা সমাজতন্ত্রের বিজয়ের পতাকা বহন করে সম্মুখে অগ্রসর হবেন। সেদিন জানবেন, এই পতাকায় আমার রক্তের ফোঁটাও রয়েছে।’

ঢাকায় যাঁরা স্তালিন নাটকের প্রতিবাদে সে নাটক বন্ধের দাবি তুলেছেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন, বুখারিনের সেই রক্তের ফোঁটার কথা আপনাদের জানা আছে? মনে তো হয় না।

বাংলাদেশের এই স্তালিনপন্থীদেরই-বা দোষ দিই কী করে, একসময় পৃথিবীসেরা বুদ্ধিজীবীরাও স্তালিনের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এঁদের একজন ছিলেন জ্যাঁ পল সার্ত্রে। তিনি বলেছিলেন, যারা স্তালিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নামে কুৎসা রটায়, তারা সবাই কুকুর। প্রায় একই কথা বলেছিলেন লুই আরাগঁ, যদিও পরে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন তিনি।

গ্রামশি বলেছিলেন, সত্য হলো বৈপ্লবিক। যাঁরা সোভিয়েত বিপ্লবে আমুণ্ডু বিশ্বাস স্থাপন করেছেন, তাঁদের পক্ষে এই বৈপ্লবিক বাস্তবতায় উত্তরণ সম্ভব নয় যে স্তালিন ছিলেন একজন খুনে, আর সোভিয়েত কমিউনিজম একটি নির্জলা মিথ্যা। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সাবেক কর্মকর্তা জোসেফ বার্জার স্তালিনের হাতে বন্দী একজন রুশ কমিউনিস্টের চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন। স্তালিনের গুলাগ থেকে ফিরে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা সবাই জেনেশুনে স্তালিনবাদকে মেনে নিয়েছিলাম। কারণ আমরা বিশ্বাস করতাম, স্তালিন যা করছেন, সমাজতন্ত্রের ভালোর জন্যই করছেন। কমিউনিস্ট রাজনীতি ও কমিউনিস্ট আদর্শের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকতে পারে, এ কথা আমরা বিশ্বাসই করতাম না।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের দোটানাটা বোঝা কঠিন নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কমিউনিজম তাঁদের কাছে একটি স্বপ্নের নাম। কীভাবে সে স্বপ্নকে তাঁরা অস্বীকার করেন! নিজেদের যৌবনের একটি বড় অংশ তাঁরা ব্যয় করেছেন সে স্বপ্নকে তাড়া করে ফিরতে। বিদেশি চর হিসেবে স্তালিনের আদালতে হাজির হওয়ার পর কোনো কোনো কমিউনিস্ট মিথ্যা হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেন, তাঁরা আসলেই চর। আমরা এখন জানি তার আসল কারণ নিজের জীবন গেলেও কমিউনিস্ট–স্বপ্ন বিপন্ন হোক, এঁরা তা চাননি।

আমি নিজে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নে দীর্ঘদিন কাটিয়েছি। স্তালিনের মৃত্যুর তিন দশক পরেও আমি দেখেছি, অনেক রুশের পক্ষে এ কথা মেনে নেওয়া কঠিন, কোনো কারণ ছাড়া, শুধু ক্ষমতার জন্য স্তালিন লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছেন। অথচ সেটাই সত্যি। স্তালিন নিজে বিশ্বাস করতেন, তিনি সব আইনের ঊর্ধ্বে। অলটার লিটভিন ও জন কিপ তাঁদের স্তালিনিজম গ্রন্থে অবমুক্ত তথ্য ব্যবহার করে মায়ের সঙ্গে স্তালিনের একটি কথোপকথন উদ্ধৃত করেছেন। ১৯৩৫ সালে তিবিলিসে স্বল্প সময়ের জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন স্তালিন। বৃদ্ধ মা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, বাছা, তুমি এখন কী করো? স্তালিন বলেছিলেন, তুমি তো জারের কথা জানো? আমি এখন অনেকটা জারের মতো। বৃদ্ধা একমুহূর্তের জন্য থমকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, জার না হয়ে তুমি যদি পাদরি হতে, তাহলেই ভালো হতো।

হায়, কী সত্যি কথাটাই না সেই বৃদ্ধা বলেছিলেন! ইলিয়া এরেনবুর্গ স্তালিনের মৃত্যুর পর বলেছিলেন, স্তালিনের অপরাধের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো কার—মানুষের, না সমাজতন্ত্রের? নিজেই উত্তর দিয়েছিলেন, মানুষের ক্ষতি হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সমাজতন্ত্রের ধারণার ক্ষতি হয়েছে, আমার তা মনে হয় না।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে, সোভিয়েত কমিউনিজমেরও পতন হয়েছে। কিন্তু বৈষম্যহীন নাগরিক সমাজ গঠনের যে স্বপ্ন, তার মৃত্যু হয়নি। পৃথিবীর সর্বত্র, এমনকি এই আমেরিকাতেও, এক বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের লড়াই চলছে। এই সমাজের নাম সমাজতন্ত্র, সে কথা বলতেও অনেকের আপত্তি নেই।

বাংলাদেশের স্তালিনপন্থীরা যতই স্তালিনিজম জিন্দাবাদ বলুন, তিনি এখন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। তাঁরা যদি স্তালিনকে আঁকড়ে না থেকে সমাজতন্ত্রের জন্য যে লড়াই, তাতে হাত লাগান, তাহলেই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেবেন।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি