কানে গুজব, হাতে আইন

বিশ্বস্ত বন্ধু ব্রুটাসসহ উজির–নাজির–মোসাহেবরা ষড়যন্ত্র করে জুলিয়াস সিজারকে মেরে ফেললেন। প্রজারা গেল খেপে। জনতা হয়ে গেল ‘মব’ বা ‘উত্তেজিত জনতা’। তারা চক্রান্তকারী সন্দেহে যাকে-তাকে ধরে পিটুনি দেওয়া শুরু করল। চক্রান্তকারীদের একজনের নাম ছিল চিন্না। কিন্তু শুধু নাম মিলে যাওয়ায় ভুল করে মবের রোষানলে পড়ে গেলেন গেইয়াস হেলভিয়াস চিন্না নামের একজন নিরীহ কবি।

শেক্‌সপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্য—
চিন্না: সত্যি বলছি, আমার নাম চিন্না।
প্রথম সাধারণ প্রজা: ওকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলো! ও চক্রান্তকারী!
চিন্না: আমি কবি চিন্না! আমি কবি চিন্না! আমি ষড়যন্ত্রকারী চিন্না নই!
চতুর্থ প্রজা: চক্রান্তকারী চিন্না হোক আর না হোক, ওর নাম চিন্না তো! এটাই যথেষ্ট, ও যেসব ফালতু কবিতা লিখেছে, তার জন্যই ওকে ছিঁড়ে ফেলো!

শেষ পর্যন্ত গণপিটুনিতে মারা গেলেন কবি চিন্না। ২০০৪ সালে বগুড়ায় পথকবি মোসলেম উদ্দিনকেও পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল উত্তেজিত জনতা। মোসলেম উদ্দিন কবিতা লিখে নিজে ছাপিয়ে নিজেই হাটে হাটে বই বিক্রি করতেন। সেই কবিতার মধ্যে ধর্মবিরোধী ভাষ্য আছে—এমন অভিযোগ তুলে জনতা তাঁকে মেরে ফেলেছিল। ‘মব’ এমনই ভয়ানক জিনিস। তারা তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ এসবের অপেক্ষা করে না। আইনেরও ধার ধারে না। তাদের কাছে নিজেদের ধারণাই সাক্ষ্য। ধারণাই প্রমাণ। সুতরাং ‘পিটা! মাইরা ফ্যালা! জানে মাইরা ফ্যালা!’

কয়েক দিন ধরে নারী, বৃদ্ধ, এমনকি মানসিক ভারসাম্যহীন লোকজনকে ‘ছেলেধরা সন্দেহে’ মহাসমারোহে বাঁশ, রড, লাঠি দিয়ে উন্মত্তের মতো পিটিয়ে মারা হচ্ছে। জনতা ভুলে গেছে, কেউ যদি সত্যি সত্যি ‘ছেলেধরা’ হয়েও থাকে, তাহলেও তাঁকে পেটানো যায় না। আইনত তো নয়ই, নৈতিক, ধর্মীয় কিংবা অন্য কোনো বিবেচনায়ই নয়। কিন্তু আত্মবিস্মৃতি ও যুক্তিহীনতাই যেহেতু উত্তেজিত জনতার স্বভাবধর্ম, সেহেতু তারা ভুলে যায়, অপরাধ যতই নৃশংস হোক, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পেছনে যতই মহৎ আদর্শ বা যৌক্তিক দাবিদাওয়া থাকুক, তাতে অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার চলে যায় না।

উত্তেজিত জনতা ‘উত্তেজিত’ থাকে বলে তারা হয়তো আইনকানুন বা নীতি নৈতিকতার ধার ধারে না। কিন্তু সরকার বা প্রশাসনের এই নৈতিক বিস্মরণ কেন? পিটিয়ে মানুষ মারার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এই রহস্যময় নীরবতা কেন?

কেন অনেক মানুষ একসঙ্গে এমন ঘাতক হয়ে উঠছে, কাউকে ‘ছেলেধরা’ বলে নিজেরাই একই সঙ্গে বিচারক ও জল্লাদ হয়ে উঠছে, সেই প্রশ্ন সেই আদ্যিকাল থেকে উঠছে এবং আদ্যিকাল থেকে যে উত্তর শোনা গেছে, এখনো তা-ই শোনা যাচ্ছে। এই হিংস্রতার অযুতবিশ্রুত ব্যাখ্যা: পুলিশ প্রশাসনের ওপর জনতার ভরসা নেই বলেই তারা আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয়। পুলিশকে বলে লাভ নেই, এমন মানসিকতা থেকেই গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে।

কিন্তু শুধু এই যুক্তি দিয়ে গণপিটুনি নামক সামাজিক ব্যাধির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয় না। এই ব্যাধি সমাজের অন্তর্নিহিত হিংস্রতার পরিণাম। সামাজিক হিংস্রতা নানাভাবে নিজেকে জাহির করে চলছে। আমাদের সমাজ প্রমাণ করে চলেছে গার্হস্থ্য হিংসা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক হানাহানি—বিভিন্ন পরিসরেই সে অতি হিংস্র। পুরো ঘটনার বিন্দুবিসর্গ জানেন না—এমন লোকও গণপিটুনিতে যোগ দিচ্ছেন। কোথাও হয়তো ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে মারা হচ্ছে, পাশ দিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। তিনি কিছু না জেনেশুনেই লোকটাকে ঘা কতক দিচ্ছেন। ‘হাতের সুখ’ নেওয়ার ইচ্ছে আছে, কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না। তাই দল বেঁধে পিটুনি। সবাই মিলে মারলে দায় কারও একার থাকে না। পুরো বিষয়ই অ্যানোনিমাস হয়ে যায়। তাই ‘মারো, মেরে হাতের সুখ নাও’। এই ‘হাতের সুখের’ কারণেই ‘গণধোলাই’ নামক জিনিসটি ‘সভ্য’ একবিংশ শতাব্দীতেও তার পাশবিক আবেদন হারায়নি। অসীম আত্মপ্রবঞ্চনায় এই সমাজ নিজেকে সচেতন ও বিবেকবান বলে দাবি করে। অথচ এই পরিব্যাপ্ত হিংস্রতা দমন করার কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেই।

সারফুদ্দিন আহমেদ, লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]