চিকিৎসক বণ্টনে অসামঞ্জস্য

বাংলাদেশের সরকারি খাতের চিকিৎসাব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে যেসব সমস্যা জমে উঠেছে, সেগুলোর অন্যতম হলো চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট লোকবলের সুষম বণ্টনে গুরুতর অব্যবস্থাপনা। দেশের সংখ্যাগুরু জনগণের বাস গ্রামাঞ্চলে, কিন্তু চিকিৎসাসেবা হয়ে উঠেছে শহরকেন্দ্রিক। এই প্রবণতা ক্রমেই বেড়েছে এবং এখন তা হয়ে উঠেছে মূলত রাজধানীমুখী। একদিকে সারা দেশের সব বিভাগের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকের গুরুতর ঘাটতি চলছে, অন্যদিকে অনুমোদিত পদসংখ্যার অনেক বেশি চিকিৎসকের ভিড় জমেছে ঢাকা বিভাগে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে নবম গ্রেডের চিকিৎসকের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৫ হাজার ৯৫৬। কিন্তু নিযুক্ত আছেন 

৮ হাজার ৪৭০ জন। অর্থাৎ অনুমোদিত পদের তুলনায় ৪২ দশমিক ২ শতাংশ চিকিৎসক জড়ো হয়েছেন এই এক বিভাগে। কিন্তু দেশের অন্য সব বিভাগের চিত্র এর ঠিক উল্টো। সেগুলোতে অনুমোদিত পদসংখ্যার ৪২ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত পদ খালি আছে। সবচেয়ে বেশি পদ খালি আছে বরিশাল বিভাগে
(৬৩ দশমিক ২ শতাংশ)।

দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসকের সুষম বণ্টনের কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যবিষয়ক থিংক ট্যাংক স্বাস্থ্যনীতি সংলাপ এ নিয়ে গত শনিবার এক আলোচনার আয়োজন করেছিল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে চিকিৎসকের ঘাটতি একটি পুরোনো সমস্যা। এই সমস্যা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপগুলো কী হতে পারে, তা নির্ধারণের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সমস্যাটির কারণ শনাক্ত করা। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যদি এ ধরনের নীতি সংলাপের পরামর্শ ও পর্যবেক্ষণগুলো বিবেচনায় নেন, তবে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।

সরকারি চিকিৎসকদের সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে মূল বাধা হচ্ছে চিকিৎসকদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে দায়িত্ব পালন ও কর্মস্থলে বসবাসের অনীহা। এই অনীহার কিছু বাস্তব কারণ আছে। যেমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে জীবনযাপনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাব, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে সরকারি দায়িত্ব পালনের বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিষয়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে নার্স, মিডওয়াইফ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, চিকিৎসা-সরঞ্জামসহ সামগ্রিক লজিস্টিক ব্যবস্থারও প্রকট ঘাটতি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের একার পক্ষে উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

এ ধরনের সমস্যাগুলো বজায় থাকলে সরকারি খাতের চিকিৎসাসেবার মান উন্নত করা সম্ভব হবে না। উপরন্তু উন্নত চিকিৎসার জন্য শহরমুখী প্রবণতা বাড়তে থাকলে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে রোগীর চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে এবং তার ফলে শহরের বড় হাসপাতালগুলোরও চিকিৎসাসেবার মান নিম্নগামী হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই রাজধানীকেন্দ্রিক ও বড় শহরকেন্দ্রিক চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে ক্রমেই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতেই হবে।

কিন্তু সেটা খুব সহজে সম্ভব হবে না। সে জন্য প্রথমেই স্বাস্থ্য খাতের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক স্বার্থের বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে; দলপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করতে হবে। ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবল কমিয়ে অন্যান্য বিভাগের শূন্য পদগুলো পূরণের জন্য যা যা করণীয়, সবই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোকে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।

সবচেয়ে বড় ও কঠিন কাজটি হলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সেবার জন্য চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করা। জাতির সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের একটা অংশ এই পেশায় আসেন; তাঁদের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক। তবে এই প্রত্যাশা পূরণের জন্য তাঁদের নানা ধরনের প্রণোদনারও ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ ভাতা, তাঁদের বসবাস ও দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত লজিস্টিক সুবিধা ইত্যাদি নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন।