ভাঙনের খবর বিজ্ঞান জানে, সরকার জানে না?

মানিকগঞ্জের ঘিওর-দৌলতপুর হয়ে টাঙ্গাইলের নাগরপুর-গয়হাটা দিয়ে যমুনার দিকে নৌকা চলছিল।

বানবন্যার দেশে বন্যা আবার নতুন কী? বর্ষায় খাল-বিল, নদী-নালা থই থই করবে। নাইওরে যাবে কন্যা। জমিজমা প্লাবিত হবে, শক্তি নেবে জলের ধারা থেকে। এটাই বাংলার নিয়ম। বানবর্ষাকে আয়ত্তের মধ্যে রাখা তেমন কোনো কঠিন কাজ কি? বর্ষা সামলানোর সব উপাচার আমাদের নাগালের মধ্যেই আছে, তারপরও বন্যা চলে যায় আয়ত্তের বাইরে। নির্মম বাক্যের বান ছোটে বিশেষজ্ঞদের মুখ থেকে। বাঁধের বাইরে মানুষ ঘর বানালে তাকে ডুবতে হবে। সে তার কপাল। সাঁতার জানলে সে ভাসতে পারে, নৌকা থাকলে পালাতে পারে শুকনা কোনো বাঁধে। ধানে মার খেয়ে সাঁতারের দম হারিয়ে ক্লান্ত কৃষকের হাতে নৌকার রাহা খরচও নেই। লগি–বৈঠাও তার হাতছাড়া এখন।

আমাদের নৌকাকে তাই বারবার ডাকছিল ঘরের বাঁধন খুলে মাজা পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন। অপার হয়ে বসে থাকা নিরুপায় সেসব মানুষের কাছে আমরা যেন দূরে থাকা কোনো দয়াময়। বানভাসি মানুষের তালাশ নিতে নিতে এই পথে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর যাওয়া খুব সহজ ছিল না। মাঝি মাঝেমধ্যেই দিকভ্রষ্ট হচ্ছিলেন। হঠাৎ ফুঁসে ওঠা যমুনাকে মাঝি ঠাহর করতে পারছিলে না দিনেদুপুরে। বানের কেন এত তোড়? হাসান মাঝিও খোঁজ রাখেন। বলেন, পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের মুখ বন্ধ হয়ে আছে আজ তিন বছর। ময়মনসিংহের শুকনা শীতলক্ষ্যায় পানি নেই, এদিকে সব চোটপাট? এই পথে না গেলে যমুনার বুকে এখনো জেগে থাকা চৌহালীর সিকি অংশের সন্ধান পাওয়া যেত না।

একটি স্কুল বাঁচাতে
বানের সঙ্গে বসবাস করা যায়, কিন্তু ভাঙনে ভরসা নেই। ৫০ বছরের পুরোনো হাইস্কুল ভেঙে যাচ্ছে যমুনায়। তার পাশেই চরপাচুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেটাও চলে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে প্রধান শিক্ষিকা চেষ্টা করছেন যতটুকু বাঁচানো যায়। সখিনা বেগম যেন নাঙ্গা তলোয়ার হাতে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার এক সেনাপতি। ছেলেবেলায় দাদির গল্পের সখিনা বিবি যেন পুরোনো পুথির পাতা থেকে বেরিয়ে এসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এক অসম যুদ্ধের। কোথায় সোহরাব, কোথায় রুস্তম। তাঁর স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ২৭ জন শিক্ষার্থীর ২৪ জনই ছাত্রী। দেশের এই চরম খিরকিতে (পেছনে) থাকা এক বিপন্ন জনপদের মেয়েশিশুরা দলে দলে স্কুলে আসে। ছেলেদের থেকে সংখ্যায় তারা বেশি। ছেলেরা কেন আসে না, অর্থনীতির সে বয়ান বড় করুন, সে আরেক কাহিনি। সেটা আজ থাক। স্কুলে মেয়েশিশুদের এই সখিনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে স্কুল থেকে ঝরে পড়া ছেলেরাও। সবাই হাত লাগিয়ে যা বাঁচাতে পারছে নিয়ে রাখছে প্রধান শিক্ষিকার এখনো–জেগে–থাকা ভিটায়।

‘মানি ইজ নো প্রবলেম’?
উজানে নৌকা ভাসানোর আগে ঢাকায় এক সভায় শুনে গিয়েছিলাম আমাদের সক্ষমতার গালগল্প। দুর্যোগে শিক্ষা চালু রাখার জন্য কোটি কোটি টাকা এখন তাঁদের ট্যাঁকে। চকচকে ছক দেখালেন সভায়। ছক পূরণের সঙ্গে সঙ্গেই যেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলে টাকা টকাটক পৌঁছে যাবে। সভা জানাল, ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’।

সখিনা বেগম এসবের কিছুই জানেন না। তাঁকে জানানো হলে দৌড় দেন শিক্ষা অফিসে। সব রেডি, বিকল্প স্কুল চালুর সব খরচ জলদি পেয়ে যাবেন। পাঁচ দিন পর ২১ জুলাই ফোন করে জানলাম কিসের কী? সদরে তাঁর ধরনা দেওয়াই সার। সময় নষ্ট; টাকার শ্রাদ্ধ। বিশ্বাস হারাতে না করি। বলি, সবুরে মেওয়া ফলবে, ধর্মের কথা বিফলে যাবে না নিশ্চয়!

প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৩–এর এডুকেশন ইন ইমারজেন্সি খাতের আওতায় সংস্থানকৃত অর্থ ব্যবহারের নীতিমালা সত্যায়িত কপি ফাইলে ফাইলে শোভা বর্ধন করিয়ে বান কি মুনদের বাণ মারা সহজ, কিন্তু বানভাসি মানুষের কাছে তা দুর্বোধ্য শ্লোক মাত্র।

বিশেষজ্ঞরা যদি জানতেন?
কোথায় এবার নদী ভাঙবে, তা ফেব্রুয়ারি মাসের আগেই আমাদের বিজ্ঞানীরা প্রায় ঠিক ঠিক বলতে পারেন। কিন্তু সে পারা দিয়ে কী হবে, সখিনা বেগমরা যদি তা ভাঙনের আগের দিনও জানতে না পারেন?

হাসান মাঝির কথার সঙ্গে ঢাকার পানি বিশেষজ্ঞরা একমত। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের বন্ধ হয়ে যাওয়া মুখ পুনঃখনন করে যমুনার ভাটি ও উজানে পানির চাপ কমানো সম্ভব। সেটা কেন করছি না।

মানুষের গবাদি, গবাদি-মানুষ
ফুলছড়ি উপজেলা অফিসের একতালা–দোতলায় এখন মানুষ আর গবাদি প্রাণী একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকছে। এসব গবাদি প্রাণীর এখন প্রাণ রক্ষা করা দায়। গোখাদ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। ৯০০ টাকার ভুসির বস্তা দুদিনের ব্যবধানে ১ হাজার ৩০০ টাকা। দুর্বল গবাদি প্রাণীর রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। খুরারোগের ঝোঁক এই অঞ্চলে সব সময় থাকে। কথা ছিল বর্ষার আগেই এসব প্রাণীর প্রতিষেধক দিয়ে রোগের ঝুঁকি কমিয়ে ফেলা হবে। ওষুধের মজুতে কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু সব জায়গায়, বিশেষ করে বন্যার ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলে এ রকম কোনো অগ্রাধিকার ছিল না। ধানের দাম না-পাওয়া কৃষক আসন্ন কোরবানির ঈদে তাঁর গবাদিটা বিক্রি করে আমনের আবাদ ধরার স্বপন দেখেছিলেন, সেটাও ক্রমে দূরে চলে যাচ্ছে।

যাঁদের ঘর ভাঙছে নদীতে, তাঁদের জন্য শাড়ি–লুঙ্গি আর কেজি কয়েক চালের ভিক্ষামার্কা ত্রাণ না দিয়ে তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য নৌযান সহযোগিতা আর নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

বিদেশিরা কোথায়?
এবারের বন্যা আর নদীভাঙন প্রলম্বিত হবে। আগামী ১০ সপ্তাহ থাকবে বন্যার আপদ–বিপদ আর পানিবাহিত রোগের নানাবিধ উপদ্রব। ত্রাণ তৎপরতাকে সাজাতে হবে সেই আলোকে। সব এলাকার ছবি একরকম নয়, চাহিদাও এক নয়। সেটা ঢাকায় বসে মাপা যাবে না। রোহিঙ্গা তৎপরতায় ক্লান্ত বিদেশি সংস্থাগুলোর কোনো পদস্থ কর্মকর্তাদের উপদ্রুত এলাকায় দেখতে না পাওয়াটা অনেককেই বিস্মিত করেছে। এটা কি নেহাতই তাঁদের ক্লান্তি, না অনেক জানার নতিজা। প্রতিটি বন্যা যেমন ভিন্ন, তেমনি বন্যা ব্যবস্থাপনার ভিত্তিই হচ্ছে স্থানীয় প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এবং সেই চাহিদা সতত পরিবর্তনশীল। তাই পরিস্থিতির নিবিড় নজরদারির কোনো বিকল্প নেই।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
nayeem5508 @gmail.com