মানুষ এত আতঙ্কিত কেন?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নাভিশ্বাসে ছুটছেন হুমায়ুন ফরিদী। তাঁর পেছনে ছুটছেন শাবানা, চম্পা ও সুবর্ণা মোস্তফা। ফরিদী রীতিমতো চোখে সরষে ফুল দেখছেন। একবার এদিক যান, তো আরেকবার ওদিকে। কিন্তু কোনোদিকই তাঁর জন্য খোলা নয়। ডানে ছুটতে গিয়ে দেখেন সেদিকেও উন্মত্ত জনতা ছুটে আসছে তাঁরই দিকে। এবার বামে মোড়; সেদিকেও রাগী উন্মত্ত জনতা। একসময় এই জনস্রোত তাঁকে চারপাশ থেকে চেপে ধরে। না, কোনো সত্য দৃশ্য নয় এটি।

বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যাঁদের যোগ আছে, তাঁরা হয়তো এরই মধ্যে ধরে ফেলেছেন যে, এই দৃশ্য ‘পালাবি কোথায়’ চলচ্চিত্রের। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া প্রয়াত শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত এই চলচ্চিত্র মূলত কর্মক্ষেত্রে নারী নিগ্রহ ও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের বক্তব্যকেই সামনে আনে। আর এই শেষ দৃশ্যটি মূলত দীর্ঘ অপশাসনের ফলে সৃষ্ট জনরোষেরই চিত্রায়ণ।

এই জনরোষ নানাভাবে তৈরি হতে পারে। এর প্রকাশও নানাভাবে হতে পারে। জনরোষের পূর্বাবস্থা মূলত হতাশা, যা অগণিত সাধারণের মধ্যে নিরঙ্কুশ হয়ে দেখা দেয়। দীর্ঘদিন নির্যাতিত হওয়া এবং কোনোভাবেই এ থেকে পরিত্রাণ না পাওয়া, বিচার না পাওয়া ইত্যাদি নানা কারণেই এ জনরোষ জন্ম নিতে পারে। বিশেষত যখন ক্ষমতার উৎস ও নির্যাতকের পরিচয় এক হয়ে যায়, যখন একাধিপত্যই শেষ কথা হয়ে ওঠে, তখন মানুষ জেরবার হয়ে পড়ে। তার হতাশা পৌঁছায় চূড়ান্ত পর্যায়ে, যেখান থেকে তার পক্ষে আর নিজেকে প্রশমিত করাটা সম্ভব হয় না। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিই তাকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য করে। চলচ্চিত্র হলে শেষ দৃশ্যে হয়তো উর্দি পরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখা মেলে, যারা অনাদিকাল থেকেই ‘আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার’ পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে গণমাধ্যমে এমন বক্তব্য প্রচার ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। কারণ ঘটনাস্থল একটি-দুটি নয়, অসংখ্য।

গত চার দিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে সাতজনকে হত্যা করা হয়েছে। আসছে আরও এমন খবর। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন এক গণহিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত বলা যায়। একটি গুজবকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তাসলিমা বেগমকে যখন গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ঢুকে পড়াটাই স্বাভাবিক। একদিকে গণপিটুনির আতঙ্ক, অন্যদিকে ‘ছেলেধরা’ শীর্ষক গুজবের আতঙ্ক, দুটিই এখন এমন এক অবস্থায় রয়েছে, যার কোনো সুরাহা অন্তত কঠোর আইন বা নজরদারি দিয়ে সম্ভব নয়।

হিস্টিরিয়া আদতে কী? সোজা বাংলায় একটি মানসিক রোগ। হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে একই সঙ্গে আতঙ্ক ও মাত্রাতিরিক্ত আবেগ দেখা যায়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এ ধরনের অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে যেকোনো কিছুই করে ফেলা সম্ভব।

ঠিক এ ঘটনাটিই এখন ঘটছে। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ নিজের আতঙ্ক লাঘবে এমন নৃশংস আচরণ করছে, যা প্রাণ নিয়ে নিচ্ছে অন্য মানুষের। ‘পালাবি কোথায়’ চলচ্চিত্রে হুমায়ুন ফরিদীর চরিত্রটি অপরাধ করেছিল। তারই শাস্তি হিসেবে বিচারহীন সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে গণপিটুনির দৃশ্য দিয়ে পরিচালক দর্শককে একটি সামাজিক ন্যায়বিচার পাওয়ার বোধ দিতে চেয়েছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রে এ ধরনের দৃশ্য নতুন নয়। বহু ব্যবহার রয়েছে এর। কিন্তু কোনো নিরপরাধ মানুষকে এভাবে জনরোষে হত্যার দৃশ্য সম্ভবত খুঁজলেও পাওয়া যাবে না সেখানে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটিই ঘটছে এখন বাংলাদেশে।

এর কারণ কী? মানুষ এতটা আতঙ্কের পুঁজি পেল কী করে? প্রশ্নটি নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। এর সহজ একটি উত্তর হচ্ছে, বিচারহীনতাই মানুষকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উদ্বুদ্ধ করছে। বিচারহীনতা এ সমাজে রয়েছে, এ তো অনেক পুরোনো কথা। কিন্তু এর আগে মানুষ এতটা জেরবার তো হয়নি। তাহলে এখন কেন হচ্ছে?

প্রথমেই বলতে হয়, মানুষের প্রাণী হিসেবেই বাঁচার তাগিদটি সবচেয়ে ওপরে। তার ভেতরে মূলগতভাবে দুধরনের প্রবৃত্তি কাজ করে। একটু বিশেষজ্ঞ মত নেওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩২ সালে দেশে দেশে যখন অস্থিরতা বাড়ছে, তখন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন মনোবিদ ও তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে ‘যুদ্ধ কেন হয়’, এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি ছিল মানুষকে যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে আনার একটি উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে। ফ্রয়েড সে চিঠির উত্তরে মানুষের প্রবৃত্তির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বিস্তারিতভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন, যা এখানে সবিস্তারে বলবার সুযোগ নেই। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।

ফ্রয়েড আইনস্টাইনের চিঠির উত্তরে যে দুই প্রবৃত্তির কথা বলেছিলেন, তার একটি হচ্ছে সৃষ্টিশীল প্রবৃত্তি, অন্যটি ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি। তাঁর মতে, এ দুটিই একসঙ্গে কাজ করে প্রতিটি মানুষের মধ্যে। সৃষ্টিশীল প্রবৃত্তি মানুষের প্রজাতি রক্ষার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত, যা একই সঙ্গে তাকে নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধতার মূলেও এই প্রবৃত্তি কাজ করে। অন্যদিকে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি মূলত কাজ করে আত্মরক্ষার কাজে। নিজের বা নিজের গোষ্ঠীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, এমন যেকোনো ঘটনাতেই মানুষের এই প্রবৃত্তিটি সক্রিয় হয়ে ওঠে।

রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে তার নাগরিকদের মধ্যে মোটাদাগে থাকা এই দুই প্রবৃত্তির মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করা। সাধারণ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে মানুষকে ‘নিরাপত্তাবোধ’টি দেওয়ার কাজটিও রাষ্ট্রের। এই নিরাপত্তাবোধটি মানুষের মধ্যে তৈরি করতে হলে, রাষ্ট্রকে মানুষের কথা শুনতে হয়, তার অভাব-অভিযোগ আমলে নিয়ে সেই মতো যথাযথ কাজ করতে হয়। একটি ন্যায্য সমাজ সৃষ্টি করে, ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিয়ে রাষ্ট্র নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে পারে। কিন্তু যখনই এই সবের কোনো একটিতে ঘাটতি দেখা যায়, তখনই মানুষের মধ্যে তৈরি হয় অনিরাপত্তাবোধের। অনিরাপত্তাবোধ যত বাড়ে, মানুষের মধ্যে তত অস্বস্তি বাড়ে, হতাশা কাজ করে। এটি এক-দুজন নয়, বহু মানুষকে তখন আক্রান্ত করে। এই অনিরাপত্তাবোধ থেকে উদ্ভূত হতাশাই একসময় আতঙ্কে রূপ নেয়।

বাংলাদেশে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা গণহিস্টিরিয়ার লক্ষণ নিয়ে হাজির হয়েছে, যা মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আতঙ্কের প্রমাণ বহন করে। কথা হচ্ছে, কেন এই আতঙ্ক? সাদা চোখে আতঙ্কের মূলে রয়েছে, শিশুরা। তাদের কেউ ধরে নিয়ে যাবে—এই বলে যে গুজব ছড়িয়েছে, তাই আতঙ্কের মূল কারণ। কিন্তু এমন একটি গুজব ছড়ানোর ভিত্তিটি আসলে কীভাবে তৈরি হলো?

প্রথমত, গত কয়েক মাস ধরে যে পরিমাণ শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তা আগের রেকর্ডগুলোকে ভেঙে দিচ্ছে। ফলে প্রতিটি শিশুকে নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। এর মধ্যে যখন রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুনতে হয় যে, ‘নির্যাতন আগেও ছিল, প্রকাশ পায়নি, এখন তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির কারণে তা প্রকাশ পাচ্ছে’, তখন মানুষের এই আতঙ্কের মাত্রাটি অনেক বেড়ে যায়। সঙ্গে রয়েছে চিরাচরিত বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ‘সাত খুন মাফ’ হওয়ার যে ধারা দীর্ঘদিন ধরে দেশে চলছে, তা দিন দিন বাড়ছে। পাশাপাশি রয়েছে জবাবদিহির অভাব। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরেই এর অভাব রয়েছে। ফলে মানুষ আর কারও ওপর আস্থা পাচ্ছে না। প্রচলিত প্রশাসনের ওপর একরকম বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে সে। আর এই ধাপে এসেই তার মধ্যে কাজ করছে ফ্রয়েড কথিত সেই ‘ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তিটি’, যা তাকে আপনজনকে বাঁচাতে সর্বস্ব দিয়ে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে।

বর্তমান এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সহজ নয়। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রশাসন এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়েছে। ২২ জুলাই এক চিঠিতে গুজব রোধে সারা দেশের পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ক্ষেত্রে প্রচারপত্র বিলিসহ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালানোর কথা বলা হয়েছে চিঠিতে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শেষ দৃশ্যে জনরোষ যখন প্রকাশের পথ পায়, তখন তা আটকাতে হলে শুধু এটুকুতে কাজ হবে না। মানুষকে আস্থায় নিতে হবে। আর তা করতে হলে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে জবাবদিহি নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। ক্রমেই কট্টর হয়ে ওঠা সমাজের শুশ্রূষার জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণাঙ্গ সক্রিয় করার কোনো বিকল্প নেই। আর গণতন্ত্র ছাড়া গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কখনো ক্রিয়া করে না—এটা কে না জানে।

ফজলুল কবির: সাংবাদিক
ই-মেইল: [email protected]