আমরা এখন আইন অমান্যের মহাসড়কে

ইদানীং গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার বেশ কটি ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। ছেলেধরা অভিযোগে গণপিটুনিতে তাঁদের নির্মম মৃত্যু। গত অল্প কয়েক দিনে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ১০ আর গত ছয় মাসে প্রথম আলো বলছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৩৬। ইদানীংকালের মাসগুলোর মতো অতীতেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, তবে সেগুলো প্রায়ই ছিল বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন। ঘটনাগুলোর ইদানীংকালের ধারাবাহিকতা প্রায় সবার মনে অনেক বেশি উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

কারণগুলো নিয়ে মন্তব্য-বিশ্লেষণ হচ্ছে, টক শোতে কিছু আলোচনা শুনেছি। একজন মনোবিজ্ঞানী হয়তো কারণ খুঁজবেন মানসিক বিষণ্নতা, একাকী-বন্ধুবান্ধবহীন বেড়ে ওঠা, বিভিন্ন ধরনের চাপ; ফলে কিছুটা হলেও সামগ্রিক বিকারগ্রস্ততার মধ্যে গণপিটুনিকে হয়তো দেখবেন এই একাকিত্ব ও বিকারগ্রস্ততার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। সমাজবিজ্ঞানী কারণ খুঁজবেন সামাজিক বন্ধনের শৈথিল্যের। আমাদের পারস্পরিক সামাজিক যোগাযোগের অভাব, আদান-প্রদান, আড্ডা মারার ও বিনোদনের সীমিত সুযোগে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, পেশাগত চরম প্রতিযোগিতার অসুস্থতার মধ্যে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকেই নিশ্চয়ই বলবেন, ধর্মীয় আচার-নিষেধের শৈথিল্য, ধর্মীয় নীতিনৈতিকতা ও চর্চার অভাব, ফলে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ফলে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা।

এ-গোছের সব ব্যাখ্যাই হয়তো সঠিক, আবার ততটা জুতসই না-ও হতে পারে। আইনজীবী স্বভাবতই এর ব্যাখ্যা খুঁজবেন আইনের চার দেয়ালের মধ্যে। কিন্তু আসল কারণ খুঁজতে আমাদের যেতে হবে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে।

২.

২১ জুলাই বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম বা শেষের পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছে ‘কাঞ্চন পৌর এলাকার শান্তিপ্রিয় জনগণ’। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভার ২৫ জুলাইয়ের নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য দেশের হর্তাকর্তাদের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছে তারা। ‘...ভোটের দিন কেউ বাইরে বের হতে পারবে না...নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ভোট না দিলে এলাকায় থাকতে দেওয়া হবে না’—এমন গুজবের কথা তারা বিজ্ঞাপনটিতে উল্লেখ করেছে। এটা বিজ্ঞাপনের ভাষা, রিপোর্ট বা তথ্য নয়। তা সত্ত্বেও এটা অনস্বীকার্য যে নির্বাচন এখন এই রকমই। যে রকমেরই হোক, অন্তত যদি নির্বাচনের দিনটা—আগের রাতে নয়—ব্যালটে সিল মারা হয়, তাতেই এখন আমরা হয়তো বর্তে যাব। এককথায়, নির্বাচনী ব্যবস্থায় শুধু ধসই নামেনি, ধসে গেছে। কোনো কেন্দ্রে যদি শতকরা এক শ ভাগ ভোটই পড়ে একজন প্রার্থীর পক্ষে, তাতেও আমরা অবাক হচ্ছি না। আমাদের উন্নতি এতটাই যে সোভিয়েত আমলের পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে একদলীয় কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীরাও এভাবে শতভাগ ভোট পেতেন না।

কবি শামসুর রাহমানের অনেক দশক আগের ‘এ আমার এক ধরনের অহংকার’ কবিতাটির একটি পঙ্‌ক্তি বারবার মনে হানা দিচ্ছে; কবি বলেছিলেন, ‘...যেদিকে বাড়াই হাত সেদিকেই নামে ধস...’। মনে হচ্ছে, যে প্রতিষ্ঠানটিতে সরকার হাত দিচ্ছে, সেটিই এখন ভেঙে পড়ছে। সরকার অবশ্যই অস্বীকার করবে, অস্বীকার করবে প্রতিষ্ঠানগুলোও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি বড় কলেজের ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা, ফল প্রকাশ ইত্যাদির দাবিতে আন্দোলন করছেন বেশ কয়েক মাস ধরে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছেন এই সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের জন্য। তথাকথিত উন্নয়নের গ্যাঁড়াকলে পড়ে ঐতিহ্যবাহী সাতটি বড় কলেজের দুই লাখের বেশি ছাত্রছাত্রী আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধ লাখ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত। প্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো এখনই ভেঙে পড়বে না, কিন্তু ধস যে নামছে না, সেটা তো আর হলফ করে বলা যাবে না। তবে হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ১০ টাকায় ‘চপ, চা আর শিঙাড়া’ পাওয়া যাচ্ছে। সান্ত্বনা এতটুকুই।

শেয়ারবাজারেও ধস নামছে। নির্বাচন কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ, শেয়ারবাজার—এই তালিকা বহু বহু লম্বা করতে বিশেষ কোনো বেগ পেতে হবে না। শুধু উন্নয়ন দিয়ে এই ধস রোধ করা যায় না। কেউ কখনো পারেওনি। উন্নয়ন করছি না, হচ্ছে না, হবে না—এ গোছের কথা কস্মিনকালেও কোনো সরকার বলেনি। বিশেষত, কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর সবচেয়ে কমন বৈশিষ্ট্যই হলো উন্নয়নের বুলি আওড়ানো। অর্ধশতাব্দী আগের সরকারগুলো সংখ্যাতত্ত্বে অনেক দুর্বল ছিল, অর্থাৎ বিভিন্ন সংখ্যা আর শতাংশ, যেমন হাজার হাজার কোটি টাকা আর তার সঙ্গে ৮, ৯, ১০, ১২ শতাংশের কথা বলে উন্নয়ন বুলি তখন ততটা পোক্ত করতে পারত না। কিন্তু আজকাল একদিকে কোটি কোটি আর অন্যদিকে বহু বহু শতাংশের কথায় উন্নয়নের জোয়ার বইছে। কিন্তু একটা সমাজ ও রাষ্ট্র যেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠান যখন দুর্বল হতে থাকে, তখন একটি রাষ্ট্র ব্যর্থতার দিকে এগিয়ে যায়। বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, জুভেন্টাস আর বায়ার্ন মিউনিখের মতো দলগুলো থেকে খেলোয়াড় এনে দুটো দল করে তাঁদের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলায় নামিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু খেলাটির রেফারি আর তাঁর দুই সহযোগী যদি বদ হন, তাহলে কোটি কোটি টাকার খেলাটি ভেস্তে যাবে। কারণ, রেফারি নামক প্রতিষ্ঠানটি ধসে গিয়েছিল।

৩.

আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করা, অর্থাৎ আইন না মানার উদ্দেশ্য যত ভালোই হোক না কেন, পরিণতি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য সব সময় হয়েছে করুণ। সমাজে একদল লোক যখন আইন অমান্য করবে, তখন অনেক লোকই অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখবে আর আইন না মানা লোকগুলোর পরিণতি দেখার জন্য অপেক্ষা করবে। অপেক্ষা করতে করতে যে পরিণতি হওয়ার কথা ছিল, সেই পরিণতি না হতে দেখে আস্তে আস্তে অনেকেই ভাবতে শুরু করবে যে ওর যখন পরিণতি খারাপ হয়নি, আমারও হবে না। ঘুষ নিয়ে চাকরি পেয়ে বেশ তো টিকে গেল, তিন বছর পরে পদোন্নতিও হলো, তাহলে ঘুষ দিয়ে চাকরি পেতে অসুবিধাটা কী? নির্বাচনে কারচুপিতে তা পুকুরচুরি, সমুদ্রচুরি যা-ই হোক না কেন, জেতা তো যায়। সেই জিত পাঁচ বছরের জন্য বহালও থাকছে। চতুর্দিকে আইন অমান্য করাটাই এখন আমাদের মহাসড়ক।

দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন অজুহাতে এবং হরেক রকমের গল্প ফেঁদে মানুষ হত্যার তালিকা গড়েছে। প্রথমে একটা-দুইটা, পরে হালি হালি, তারপরে ডজন, তারপরে শতক। সপ্তাহ, মাস, বছর এবং দশকও পেরিয়ে গেছে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা ব্যতীত আর কোথাও বিশেষ কোনো আইনগত পরিণতি হয়নি। এখন আমরাও আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। নির্বাচনের নামে সমুদ্রচুরিতে, ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষায় নির্বিকারে বাধা দিতে, ব্যবসা-বাণিজ্য আর নিয়োগে ঘুষ-দুর্নীতির মতো বেআইনি কাজগুলোই এখন নিয়মতান্ত্রিক। এত দিন মানুষ মরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে, এখন যেভাবে মরছে, সেটাকে আমরা বলছি গণপিটুনি; দুইটাই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এক পিঠে ‘বন্দুকযুদ্ধ’, অন্য পিঠে ‘গণপিটুনি’। বালিশ কিনছি ৬ হাজার টাকায়, বহন খরচ বালিশপ্রতি প্রায় ৭০০ টাকা, এই সবকিছুই এখন স্বাভাবিক।

আমাদের মতো বহু দেশে বছরের পর বছর এই রকম ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতি ছিল। বন্দুকযুদ্ধ, মাদক, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি দল, নির্বাচনে কারসাজি আর ঘুষ–দুর্নীতিতে ভর করে বিশাল বড়লোক হওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের কাছের যেই দেশগুলোতে এই সব কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশি, সে দেশগুলোর—যেমন গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, এল সালভাদর, নিকারাগুয়া—লাখ লাখ লোক প্রাণে বাঁচতে, জান বাঁচাতে এখন ধাবিত হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। ট্রাম্প বাধা দিচ্ছেন, সেটা অন্য কিচ্ছা।

শত শত বাংলাদেশিও বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য জীবন বাজি ধরছেন। কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়া যেতে আর এখন ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি ঘটছে অকাতরে।

গণপিটুনি তাই আরও বড় ধসের আভাস, কর্তৃত্ববাদী শাসন আর যত দিন না জবাবদিহি থাকবে, আমাদের বাঁচার চেষ্টা করতে হবে ভয়ে ভয়ে, অতি ভয়ে, দরজা-জানালা বন্ধ রেখে। তবে দেখি না, জানি না, শুনি না বলে উটপাখির মতো বালুতে মুখ লুকিয়ে ধস থেকে আমরা কেউ রেহাই পাব না।

ড. শাহদীন মালিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক