ইভিএমে ভোটের হার ও ব্যবধান দুটিই কম

একাদশ নির্বাচনের আগে ভোট গ্রহণে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহার করা না-করা নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল। বিএনপিসহ প্রায় সব বিরোধী দল ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের শরিক দলগুলো ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে অবস্থান নেয়। 

সে সময়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বিএনপির কাছে ইভিএম গ্রহণযোগ্য হবে না। এই পদ্ধতি দিয়ে কখনো নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না।’ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের মন্তব্য ছিল, ‘ইভিএম যুক্তিসংগত এবং গ্রহণযোগ্য।’

নির্বাচন কমিশন ২০১১ সাল থেকে সীমিত পরিসরে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করলেও জাতীয় নির্বাচনে প্রথম ইভিএম ব্যবহার করে ৩০ ডিসেম্বরই। তা–ও মাত্র ছয়টি আসনে। বাকি ২৯৪টি আসনে ভোট হয় ব্যালট পেপারে। ইভিএমে ভোট হওয়া আসনগুলো হলো রংপুর-৩, খুলনা-২, সাতক্ষীরা-২, ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩ ও চট্টগ্রাম-৯। নির্বাচন কমিশন বলেছে, দৈবচয়নের মাধ্যমে আসনগুলো ঠিক করা হয়েছে। 

বিরোধী দলের অভিযোগ ছিল, ইভিএমে কারসাজি করে সরকারি দল ভোটের ফলাফল পাল্টে দিতে পারে। ভোটারের উপস্থিতি অনেক বেশি দেখাবে বলেও তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, ব্যালট পেপারে ভোট নেওয়া আসনের চেয়ে ইভিএমভুক্ত আসনে ভোট পড়েছে অনেক কম। ব্যালট পেপারের আসনের গড় ভোট ছিল ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ। ইভিএমের আসনগুলোতে গড়ে ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ। দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান ২৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ব্যালট পেপারে গৃহীত ভোটকেন্দ্রগুলোর মধ্যে যেমন কোনো সংগতি নেই, তেমনি অসংগতি দেখা গেছে ইভিএমে নেওয়া ভোটকেন্দ্রগুলোর মধ্যেও। ইভিএমে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে চট্টগ্রাম-৯ আসনে—৬২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। সবচেয়ে কম পড়েছে ৪৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ—ঢাকা-১৩ আসনে। এ ছাড়া রংপুর-২ আসনে ভোট পড়েছে ৫২ দশমিক ৩১ শতাংশ, খুলনা-২ আসনে ৪৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, সাতক্ষীরা-২ আসনে ৫২ দশমিক ৮২ ও ঢাকা-৬ আসনে ৪৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। কিন্তু ব্যালট পেপারে ২১৩টি আসনে শতভাগ ভোট পড়েছে। ইভিএমে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, রংপুর-৩ আসনের দ্য মিলিনিয়াম স্টারস স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রে। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে চট্টগ্রাম-৯ আসনের আবদুল বারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে।

কৌতূহলোদ্দীপক হলো, সব আসনে নৌকা প্রতীকে ভোটের প্রাপ্ত হার ৭৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ হলেও ইভিএমে ৫৪ দশমিক ৪৩। আর ধানের শীষ প্রতীকের গড় ভোট ছিল ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ইভিএমে ১৮ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। জাতীয় গড়ের তুলনায় নৌকা প্রতীক ইভিএমে ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম এবং ধানের শীষ জাতীয় গড়ের তুলনায় ইভিএমে ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি পেয়েছে। অর্থাৎ  ইভিএমে নৌকায় তুলনামূলক কম এবং ধানের শীষ তুলনামূলক বেশি ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ ইভিএমে ভোটের হার ও ব্যবধান দুটিই কম।

গত ৮ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না। সিইসির ভাষায়, একটি ‘সফলতম’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর কেন তাঁর মাথায় রাতের ভোটের কথা এল, সেই প্রশ্ন না উঠে পারে না।  

এ বিষয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে শতভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রের চেয়ে ৫০ ভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রে অনিয়ম কম হয়েছে। ইভিএম যদি সত্যিকারভাবে ব্যবহার করা হয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত না হয়ে থাকে, তাহলেও ভোট কারচুপির শঙ্কা কম থাকে। এখানে একটি ইউনিটে একটি মেশিনই ব্যবহার করা হয়। ফলে একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারেন না, রাতে সিল মারার সুযোগও থাকে না। সত্যিকার ভোটার যাতে কেন্দ্রে যান, সেই নিশ্চয়তা নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে।

আগামী পর্ব: ভোটের ফলে নানা অমিল-অসংগতি

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]