সহিংসতার সঙ্গে জনঘনত্বের সম্পর্ক নিবিড়

একসঙ্গে অনেক মানুষ স্রেফ সন্দেহের বশে একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। যারা এই নিষ্ঠুরতায় সরাসরি হাত লাগাচ্ছে না, তারা চেয়ে চেয়ে 

দেখছে। ছোট ছোট খুকিরা ধর্ষিত হচ্ছে, ধর্ষকদের কেউ কেউ তাদের মেরেও ফেলছে। কিশোরীর হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে খুন করা হলো। তরুণকে প্রকাশ্য রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করা হলো।

এ রকম আরও অজস্র ঘটনায় মনের স্বাভাবিক শান্তি, স্বস্তি নষ্ট হয়ে গেছে। জীবনকে দুর্বহ মনে হচ্ছে। ‘এত চাপ নেওয়া যাচ্ছে না’—এ রকম কথায় মনের অবস্থা প্রকাশের চেষ্টা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

কিন্তু কেন এসব হচ্ছে, এ রকম একটা প্রশ্ন রেখেছিলাম আমার ফেসবুক বন্ধুদের সামনে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, অধিকাংশের কাছে এটা কোনো প্রশ্নই নয়। কেন এসব হচ্ছে, এ নিয়ে তাঁদের কোনো কৌতূহল নেই। কারণ, তাঁরা জানেন কেন এসব হচ্ছে। কেউ কেউ এ-ও জানেন, কী করলে এসব বন্ধ হবে। সংক্ষেপে তাঁদের বক্তব্য হলো, দেশে গণতন্ত্র নেই, একধরনের স্বৈরতন্ত্র চলছে; সে কারণে আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সাধারণ মানুষ আইন ও বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, সে জন্য তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। মোদ্দাকথা, দেশে গণতন্ত্রহীনতা ও সুশাসনের অভাবের ফলে এমন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে না; সাধারণ মানুষের আচরণেও সাংঘাতিক রকমের নিষ্ঠুরতা যুক্ত হচ্ছে।

এই বক্তব্যের সঙ্গে আমার কোনো দ্বিমত নেই। আমিও মনে করি, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও শাসনব্যবস্থার গুরুতর অবক্ষয়ের ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সে জন্য গণতন্ত্র ও সুশাসনের দাবি কখনোই ছাড়ি না।

তবে আরও একটি গুরুতর বিষয় আমি সামনে আনতে চাই, যার গভীর প্রভাব আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে রয়েছে বলে অনুমান করি। বিষয়টা হলো, অতিরিক্ত জনঘনত্ব, যা এ দেশের অজস্র সমস্যার রুট-কজ বা গোড়ার কারণ বলে আমার মনে হয়। বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই এই কারণে যে অন্য অনেক সমস্যা নিয়ে যত লেখালেখি ও আলাপ-আলোচনা হয়, সে তুলনায় জনঘনত্ব একটা সমস্যা হিসেবে প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে যাচ্ছে। এমনকি এ রকম মতেরও দেখা পাই যে জনঘনত্ব কোনো সমস্যাই নয়, বরং এর অনেক ইতিবাচক সম্ভাবনা আছে। বৃহৎ জনসংখ্যাকে বৃহৎ জনসম্পদে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন-স্লোগান যে রাষ্ট্রীয় তরফেই বেশি উচ্চারিত হয়, এটাও আমরা বেশ লক্ষ করি।

কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে জনঘনত্ব যে অস্বাভাবিক মাত্রায় উঠেছে এবং ওঠা অব্যাহত আছে, তা সব অর্থেই এক গুরুতর দুশ্চিন্তার বিষয়। ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করছে ১ হাজার ১২০ জন মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনের মোট জনসংখ্যা ১৪২ কোটি, কিন্তু সে দেশেরও জনঘনত্ব বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। চীনে এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ১৫১ জন। পৃথিবীর দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারতের লোকসংখ্যা ১৩৬ কোটি; সে দেশের জনঘনত্ব (প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাসরত মানুষের সংখ্যা) ৪৬০ জন। পাকিস্তানের জনঘনত্ব ২৬৫, শ্রীলঙ্কার ৩৩৫, নেপালের ২০৯, আর ভুটানের মাত্র ২২। ম্যাকাও, মনাকো, সিঙ্গাপুর, হংকং—এ রকম কয়েকটি ছোট দ্বীপ ও নগররাষ্ট্রের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশের জনঘনত্ব এখন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

সবচেয়ে গুরুতর দুর্দশা হয়েছে আমাদের প্রিয় রাজধানীর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টাসের তথ্যসূত্র ব্যবহার করে ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের তৈরি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর লোকসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ২০১৯ সালে ২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এখানে এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করছে ৪৬ হাজার ৯৯৭ জন মানুষ। পৃথিবীর আর কোনো শহরের জনঘনত্ব এত বেশি নয়। দ্বিতীয় জনঘন শহর ম্যানিলার জনঘনত্ব ৪২ হাজার। তৃতীয় স্থানে আছে ভারতের মুম্বাই, সেখানে জনঘনত্ব ২৮ হাজার। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর জাপানের মোট লোকসংখ্যা এখন ৩ কোটি ৭৪ লাখ; কিন্তু সেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে মাত্র ৬ হাজার ২২৪ জন।

সুতরাং ঢাকা মহানগরীর তো বটেই, গোটা বাংলাদেশেরই জনঘনত্ব অভূতপূর্ব মাত্রায় বেড়ে গেছে এবং এর ফলে শুধু যে পাহাড়, নদী, বনজঙ্গল, ফসলি জমি কমে যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তা-ই নয়, আমাদের জীবনযাপনেও অজস্র রকমের সমস্যা ও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। জায়গা কম, কিন্তু মানুষ বেশি—এ জন্য আমাদের সবকিছুতেই ঘাটতি পড়ে যাচ্ছে। বসবাসের জায়গা কম, চাষাবাদের জায়গা কম, রাস্তাঘাট, কলকারখানা তৈরির জায়গা কম, হাসপাতালে রোগীদের জন্য জায়গা কম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য জায়গা কম, শিশুদের খেলাধুলার জায়গা কম, হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল পালার জায়গা কম। বোঝা যায়, কেন বাংলাদেশে জায়গাজমির বিরোধ নিয়ে এত বেশি মারামারি-খুনোখুনি হয়। শুনেছি, গ্রামাঞ্চলে যেসব কারণে মামলা হয়, ভূমিবিরোধ সেগুলোর অন্যতম।

কে বোঝে না যে ৫০ শয্যার হাসপাতালে ৫০০ রোগীর সুচিকিৎসা সম্ভব নয়? তেমনই ৬০ আসনের শ্রেণিকক্ষে ১৩০ শিক্ষার্থীর পাঠদানের উচ্চমান আশা করা যায় না। যে লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৩০০, সেটাতে ৭০০ যাত্রী উঠলে সেটা ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যদি না-ও ডোবে, তবু ভালো যাত্রীসেবা নিশ্চিত হতে পারে না; যাত্রীদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, এমনকি মারামারি লেগে যেতে পারে। ঢাকা মহানগরীর সড়কগুলোর মোট ধারণক্ষমতার তুলনায় চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি—এটা ট্রাফিক বিশৃঙ্খলার প্রধান কারণগুলোর অন্যতম।

মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্বের এই সব নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান এবং এগুলো মোটের ওপর বোধগম্য। যা সরাসরি দৃশ্যমান নয়, যা নিয়ে তেমন আলোচনাও হয় না, তা হলো নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব। সমাজ-মনোবিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে দেখিয়ে আসছেন, অতিরিক্ত জনঘনত্ব মানুষের মানসিক অবস্থার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ, বিশেষত ঢাকা মহানগরী এ বিষয়ে গবেষণার জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান বলে আমার মনে হয়। কিন্তু জনঘনত্বের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নিয়ে এ দেশে কোনো গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার কিছু দেশ, ফিলিস্তিন, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল, শরণার্থী শিবির, কারাগার ইত্যাদি জনঘন স্থাপনায় এবং কিছু মেট্রোপলিটন শহরে গবেষণা হয়েছে। সেসব গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত জনঘনত্বের কারণে ব্যক্তির সার্বিক মানসিক স্বাস্থ্য নানা মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে রেস্টলেসনেস (অস্থিরতা), স্ট্রেইন/ইরিটেশন (চাপ/বিরক্তি), ওয়ারি/অ্যাংজাইটি (উদ্বেগ), ফিজিক্যাল অ্যান্ড সাইকোলজিক্যাল উইথড্রয়াল (সবকিছু থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া), অ্যাগ্রেশন/অ্যাগ্রেসিভ টেন্ডেন্সি (আক্রমণাত্মক মনোভাব) ইত্যাদি। অতিরিক্ত জনঘনত্বের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে মানুষের মধ্যে নানা মাত্রার সাইকোনিওরিক সিম্পটম (মনো-স্নায়বিক অসুস্থতা) দেখা দেয়—এটাও একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে। গৃহের ভেতরে অতিরিক্ত জনঘনত্বের সঙ্গে পারিবারিক সহিংসতা, আক্রমণাত্মক প্রবণতা ও সমাজবিরোধী আচরণের সম্পর্কের (রিলেশনশিপ বিটুইন ওভারক্রাউডিং, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যান্ড অ্যাগ্রেশন, অ্যান্টিসোশ্যাল বিহেভিয়ার ইন সোসাইটি অ্যাট লার্জ) প্রমাণ মিলেছে একাধিক গবেষণায়।

সুতরাং বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এটা বলা যায় যে বাংলাদেশে যেসব নৃশংস ধরনের অপরাধের বাড়াবাড়ি দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর পেছনের অনেক কারণের মধ্যে অতিরিক্ত জনঘনত্বের নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও অন্যতম।

তাহলে এখন আমাদের করণীয় কী? কীভাবে আমরা এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে বেরোতে পারি?

আমার এই লেখার উদ্দেশ্য সব সমস্যার সমাধান বাতলে দেওয়া নয়। সেই সামর্থ্যও আমার নেই। আমার উদ্দেশ্য, গুরুতর অনেক জাতীয় ও সামাজিক সমস্যার অন্যতম উৎস হিসেবে অতিরিক্ত জনঘনত্বের গুরুত্ব তুলে ধরা; এর প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কারণ, এই বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে না; অতিরিক্ত জনঘনত্ব যে একটি গভীর, বহুবিস্তৃত ও দূরপ্রসারী সমস্যা—রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক, রাজনৈতিক মহল, নাগরিক সমাজ ও গবেষক মহলে এই উপলব্ধির ইঙ্গিত মিলছে না। প্রথমত, উপলব্ধি করতে হবে, জাতীয় নীতিতে জনঘনত্বকে একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে জায়গা দিতে হবে। ইতিমধ্যে যা বেড়েছে, তা আমরা তাড়াতাড়ি কমাতে পারব না। কিন্তু এই গতিতে বাড়া যেন চলতে না থাকে, সে জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির চলমান শৈথিল্য দূর করতে হবে; এতে গতিসঞ্চার করতে হবে।

জনঘনত্ব বেশি হলে উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে যথাসম্ভব খাপ খাইয়ে চলার কিছু কৌশল বিভিন্ন দেশে নেওয়া হয়। কোপিং উইথ ক্রাউডিং/ ওভারক্রাউডিংয়ের কৌশলগুলোর মধ্যে প্রধান হলো সুশাসন/সুব্যবস্থাপনা। মানুষ বেড়ে গেলে শৃঙ্খলার প্রয়োজন আরও বেড়ে যায়; আমাদের সংস্কৃতিতে শৃঙ্খলার ঘাটতি প্রকট। গৃহস্থালি থেকে শুরু করে অফিস-আদালত পর্যন্ত সবখানেই ব্যবস্থাপনার ঘাটতি। রাষ্ট্রীয়-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনার দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি হতাশাব্যঞ্জক। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের সাফল্য নির্ভর করে ব্যবস্থাপনার গুণমানের ওপর।

শৃঙ্খলা, সুব্যবস্থাপনা, সুশাসন—এসব আপনা-আপনি আসে না, স্বল্প সময়েও আসে না। সুশাসনের সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পর্ক নিবিড়। জনস্বার্থের চিন্তারহিত আত্মকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান ঘটানো প্রয়োজন সবকিছুর আগে। সেই সঙ্গে সর্বজনীন শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শুধু পেশামুখিতা নয়, সবাই মিলে ভালো থাকা যাবে, এমন একটি দেশ গড়ে তোলার কাজে অবদান রাখার মন তৈরি হবে—এমন মানুষ গড়ার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে বড় রকমের গুণগত পরিবর্তন আনা খুব প্রয়োজন। সে জন্য প্রথমেই দরকার দক্ষ ও দায়িত্বশীল শিক্ষক তৈরির ব্যাপক উদ্যোগ। পৃথিবীর যেসব দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নতি হয়েছে, তাদের সবাই প্রথমে সুদক্ষ, দায়িত্বশীল, সংস্কৃতিমান শিক্ষক গড়ার কাজে হাত দিয়েছিল। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এশিয়ার অন্যতম দুটি দৃষ্টান্ত। ইউরোপে তাকাতে পারি ফিনল্যান্ডের দিকে। আমরা তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি।

আরও অনেক কিছু করতে হবে। সবাই ভাবুন। সমাধান খুঁজুন, পথ বাতলান।

মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]