বাংলাদেশ এবং নির্যাতন বন্ধের লড়াই

বিশ্বব্যাপী গত ২৬ জুন ‘নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনে আন্তর্জাতিক দিবস’ পালন করা হয়—যা জীবনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার প্রাপ্তি ও নির্যাতন থেকে মুক্তির একটি সুযোগ, যেগুলো বৈষম্যহীনভাবে এবং নাগরিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থান বিবেচনা না করে সব মানুষের ভোগ করার অধিকার রয়েছে।

আন্তর্জাতিক এই দিবসটির সঙ্গে ১৯৪৮ সালে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের (ইউডিএইচআর) গভীর ও বৈশ্বিক যোগসূত্র রয়েছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র আন্তর্জাতিক আইনের একটি বৈশ্বিক মানদণ্ড, যা বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির ভিত্তি হিসেবে মানব পরিবারের সব সদস্যের মর্যাদা, সমতা ও অনতিক্রম্য অধিকারের স্বীকৃতি দেয়। এতে আরও বলা হয়েছে, প্রত্যেকেরই জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে।

এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, যেখানে সব নাগরিকের আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে, যা জীবনের অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়ার পাশাপাশি গ্রেপ্তার ও আটক অবস্থার ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেয়। ইউডিএইচআরের মতো সংবিধানেও সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে কেউ যেন নির্যাতিত না হয় কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা মানহানিকর আচরণের কিংবা সাজার ভুক্তভোগী না হয়।

বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ অ্যাজেন্ডা-২০৩০ বাস্তবায়ন ও এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আইনের শাসন, সুশাসন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি এখনো চলমান আছে এবং তা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে হুমকি হয়ে উঠছে।

নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক বা মানহানিকর আচরণ কিংবা সাজার মতো ঘটনা অনেক স্থানেই ঘটতে পারে। কেবল আটককেন্দ্র বা কারাগারের মতো বন্দিদশার মধ্যেই এসব নিয়ম লঙ্ঘন সীমিত নয়, উপরন্তু বিদ্যালয়, হাসপাতাল কিংবা শিশু অথবা মানসিক প্রতিবন্ধীদের কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে বা জনসমক্ষেও নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা ঘটতে পারে, যেমন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিক্ষোভকালীন অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ।

নির্যাতন ও নিষ্ঠুর আচরণের ঘটনা অনেকভাবে ঘটতে পারে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাও নির্যাতন হিসেবে পরিগণিত হবে, বিশেষ করে যেসব জায়গায় দায়মুক্তির সংস্কৃতি ও যত্নশীল শাসনব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে এবং যেখানে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কোনো পদ্ধতিগত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর আচরণ, অমানবিক অথবা মানহানিকর আচরণ কিংবা সাজাবিষয়ক (সিএটি) জাতিসংঘ সনদ অনুসমর্থন করে। সিএটির পর্যবেক্ষক কর্তৃপক্ষ, কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার, জেনেভায় ৩০-৩১ জুলাই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সিএটির বাস্তবায়ন পরিস্থিতির ওপর পর্যালোচনা করবে। ১৯ বছর পর বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রথম রাষ্ট্রীয় প্রতিবেদনটি দাখিল করছে, যা একটি স্বাগত পদক্ষেপ।

প্রতিটি রাষ্ট্রেরই মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে। এটি প্রশংসনীয় যে বাংলাদেশ সরকার নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত ঘটনা তদন্তসংক্রান্ত সর্বজনীন পুনর্বীক্ষণ পদ্ধতি (ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক
রিভিউ) ২০১৮-এর সুপারিশকে সমর্থন করেছে। জাতিসংঘ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ আশা করে। এ ধরনের কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে, সেটি নিশ্চিত করতে আরও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (প্রতিরোধ) আইন প্রণয়ন করার জন্যও জাতিসংঘ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। যদিও এই আইনে খুব কমই মামলা, তদন্ত কিংবা বিচার করা হয়েছে। সরকারি কর্তৃপক্ষের অত্যধিক বলপ্রয়োগ, নিষ্ঠুরতা বা নির্যাতন কিংবা তাদের সহযোগিতা বা নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নির্যাতনের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসে। খুব কম ঘটনাতেই ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। বিচারপ্রার্থীকে ভয়ভীতি দেখানো ও হয়রানি করার অভিযোগও পাওয়া যায়। প্রতিহিংসামূলক আচরণ অবশ্যই দূর করতে হবে, অন্যথায় ভয়ভীতির কারণে মানুষ প্রতিকার চাওয়া থেকে দূরে সরে যাবে।

নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার কিছু অভিযোগের ব্যাপারে জাতীয় (মানবাধিকার) প্রতিষ্ঠান জড়িত হয়েছে এবং তদন্ত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার ঘটনায় অন্তত তিনজন নিহত, অর্ধশতাধিক আহত এবং প্রায় ২ হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়। হামলাকারীরা এই সম্প্রদায়ের মানুষজনের ঘরবাড়ি ও গবাদিপশু লুট করে নিয়ে যায় এবং প্রায় ৬০০ বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এই দৃষ্টান্তহীন উচ্ছেদের ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার পর সে সময় নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীবিষয়ক পার্লামেন্টারিয়ান-ককাসের সঙ্গে তথ্যানুসন্ধান চালায় এবং প্রতিরোধ ও ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সুপারিশ করে। বিষয়টি বিচারাধীন।

আসন্ন সিএটির পর্যালোচনা এসব ঘটনা সুরাহায় বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিতে যাচ্ছে, তা তুলে ধরার একটি সুযোগ করে দেবে। এ আলোচনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার জবাবদিহি জোরদারকরণ, তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ প্রদান, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত ও অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা, সাক্ষীর ও বিবাদীর সুরক্ষা, আইনজীবী ও নীতিনির্ধারকদের নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ এবং সাধারণ মানুষ, যারা নিজেদের অধিকারের বিষয়ে খুব কমই সচেতন, তাদের মধ্যে তথ্যের প্রচারণা চালানোর জন্য প্রচলিত
আইন ও নীতিমালার কঠোর বাস্তবায়নের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

জাতিসংঘ মহাসচিব সব রাষ্ট্রের প্রতি ‘দোষী ব্যক্তিদের দায়মুক্তি থেকে অবসান ঘটানোর এবং মানবতাবিরোধী নিন্দনীয় কর্মকাণ্ড সমূলে দূর করার’ আহ্বান জানিয়েছেন। নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিসহ সবার জন্য এ বিষয়টি বাস্তবতায় পরিণত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে জাতিসংঘ প্রস্তুত।

মিয়া সেপ্পো: বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী