তিতাস একটি হত্যাকাণ্ডের নাম

তিতাস ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত
তিতাস ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত

ভিআইপি আসতে তিন ঘণ্টা দেরি হয়েছে। তাই তিতাসকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি নিয়ে ফেরি ঘাট ছাড়তে পারেনি।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’। তিতাসকে নদী ভেবে অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১) উপন্যাস লিখেছিলেন। ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক যখন সিনেমা বানালেন, তখন তিতাস হলো নায়িকা। ঋত্বিক লিখেছিলেন, অদ্বৈতবাবু যে সময়ে তিতাস নদী দেখেছেন, তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। প্রায় সাত দশক পরে আমরা নদীপাড়ে আরেক তিতাসকে যখন দেখি, তখন সভ্যতা কি বাঁচতে বসেছে নাকি মরতে বসেছে নাকি মরে গেছে?

১৯৫১ সালে অনানুষ্ঠনিকভাবে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটেছিল। আমরা যদি কদিন আগের হাইকোর্টের একটি পর্যবেক্ষণ স্মরণে রাখি, তাহলে কী দাঁড়ায়? জমিদারি প্রথা মরেনি। বেঁচে আছে। তাদের নাম পাল্টেছে। লেবাস বদলেছে। কিন্তু জমিদার, নায়েব–গোমস্তারা আমাদের লোকালয়ে গিজগিজ করছে। নুসরাত হত্যা মামলায় ওসি মোয়াজ্জেমের বিষয়ে তখন হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছিলেন, ‘কিছু কিছু ডিসি ও ওসি আছেন, যাঁরা নিজেদের জমিদার মনে করেন। সর্বেসর্বা মনে করেন। সবাই কিন্তু না। অনেক দেশেই এমন আছে, তবে আমাদের দেশে বেশি।’

কিছু ওসির মধ্যে মোয়াজ্জেম একটি উদাহরণ। কিন্তু কিছু ডিসিকে জমিদার হিসেবে চিত্রিত করার তিনটা সপ্তাহ না ঘুরতেই আমরা জমিদার ডিসির উদাহরণ পেলাম। ৭০ বছর আগে হয়তো ওই নদীতীরে জমিদার তার লাঠিয়ালের হুকুমে নৌকা ছাড়েনি। আজ ৭০ বছর পরে নদীতীরে মৃত্যুপথযাত্রী জেনেও তিতাসকে নিয়ে ফেরি ছাড়েনি।

তিতাস নিশ্চয় মৃত্যুর আগে অস্ফুটে বলে গেছে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। কে জানে মাত্র এক বছর আগেই, তার বয়স যখন আরও এক বছর কম ছিল, তখন সে মিছিলে গিয়েছিল। সরবে, কিংবা নীরবে, সে বলেছিল, নিরাপদ সড়ক চাই। কেউ হয়তো লক্ষই করেনি, কিশোর তিতাস দ্রোহের ফুলকি হয়ে ওঠা মীম ও রাজিবের জন্য দুই ফোঁটা চোখের জল ফেলেছিল।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ঢেউ দেশের ৪২টি জেলায় আছড়ে পড়েছিল। সেটা নিশ্চয় নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পৌর শহরটিকেও স্পন্দিত করেছিল। ২৯ জুলাই ছিল সেই আন্দোলনের এক বছর পূর্তি। এর ঠিক আগমুহূর্তে, কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাসের রক্ত ঝরল সড়কে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিল সে। একালের জমিদারি ব্যবস্থার নিপীড়নে তার চিকিৎসা ব্যাহত হলো। তিতাস থাকল চিকিৎসাবঞ্চিত। অথচ এই ঘটনায় পুলিশ কোনো মামলা দেয়নি। মামলা না হলে তো পুলিশের আবার হাত–পা বাঁধা। তারা আইনের লোক। আইনের বাইরে তারা যাবে কী করে।

তিতাস ফেরিতেই নদীবক্ষে বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারিয়েছে। তিতাসের অকালমৃত্যুর দৃশ্য ভাইরাল হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন খুব সহজ, ভিআইপি যুগ্ম সচিব এবং ভিআইপি ডিসি সাহেব কি তিতাসের মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন?

ফেনীর নুসরাতের বিয়োগান্তক মৃত্যুর রেশ মিলিয়ে যায়নি। ঘটনায় ফেনীর ওসি মোয়াজ্জেমের বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু ফেরি না ছাড়ার কারণে শিশু তিতাস ঘোষের যে ফেরিতেই মৃত্যু ঘটল, সে জন্য কারও বিচার শুরুর সম্ভাবনা কম। নুসরাতের ঘটনায় নৃশংসতা ছিল অনেক বেশি এবং একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। দেশে-বিদেশে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। তাই ওসি মোয়াজ্জেম পার পাননি। তারপরও তাঁর গ্রেপ্তারপর্ব খুব সহজ ছিল না।

৯ জুলাই বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওসি মোয়াজ্জেমের জামিনের আবেদন খারিজ করেছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল স্বয়ং আদালতে হাজির থেকে জামিনের বিরোধিতা করেছিলেন। ওই দিনের শুনানিতে আদালতের মন্তব্যের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ একমত হয়েছিল যে ‘দায়িত্ব বা ক্ষমতা থাকার পরও সে দায়িত্ব পালন না করার কারণে যদি কোনো দুর্ঘটনা বা অপরাধ ঘটে, তবে সে জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিও সমান দায়ী।’

আমরা বাস্তবতা মেনে নিতে রাজি আছি। একথা ঠিক যে সময়–সুযোগ থাকলে মাঝেমধ্যে ফেরি ব্যবহারে ভিআইপিদের একটা অগ্রাধিকার দেওয়া বাস্তবতা। কিন্তু সেটাও দেওয়া উচিত নয়। কারণ, আইনের শাসন তা সমর্থন করে না। আমাদের আজকের এই দশার কারণ নির্দেশ ও তদবির। কোথাও কোনো সিস্টেম কাজ করে না। ভিআইপির জন্য লিফট থামিয়ে রাখা এখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

আইনের শাসন ও আইনের চোখে সমতার নীতি নিয়ে মানবাধিকার কর্মীরা যে বিশ্বের দেশে দেশে মুখর থাকেন, তার মূল কারণ এটাই। আইনকে তার পথে চলতে না দিলে বাধাবিঘ্ন ঘটবেই।

ভিআইপিরা ভিআইপি মর্যাদা নেবেন, সেটা ততক্ষণ অনুমোদনযোগ্য, যতক্ষণ তা আমজনতার নিয়মিত অধিকারকে ক্ষুণ্ন না করে। তিতাসকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স হয়তো সব দিন ওই রকম সময়ে পারাপারের জন্য অপেক্ষমাণ থাকে না। তেমন অবস্থায় যদি ফেরি ছাড়তে আরও বিলম্ব ঘটত, তাহলে তার মাশুল হয়তো এতটা চড়া হতো না।

যিনি ওই পথে আসছিলেন, তিনি অন্য একটি জেলার সাবেক ডিসি ছিলেন। তাই ফেরি ধরতে তিনি বর্তমান ডিসিকে ফোন করেন। ডিসি বলেছেন, সাবেক ডিসি বা ভিআইপিকে এ রকম সুবিধা দেওয়ার নিয়ম আছে। আমরা এ পর্যন্ত ডিসির সঙ্গে কষ্টেক্লিষ্টে একমত হতে পারলেও, আমরা যেটা নিতে পারি না, সেটা হলো, যখন তিনি বলেন, ‘ওই ঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে একজন গুরুতর আহত অবস্থায় রোগী আছে, তা আমি জানতাম না। ঘাটের ম্যানেজার এ বিষয় আমাকে কিছু জানাননি।’

নিশ্চয় তাঁর জানার কথা নয়। কিন্তু তিনি তো একটি অস্বাভাবিক অনুরোধ করেছিলেন। সুতরাং ডিসির এটা দায়িত্ব, তাঁর অনুরোধ বা আদেশের ফল কী হতে পারে, তা বিবেচনায় নেওয়া। ডিসি এ কথা বলে তাঁর দায় তাঁর কাঁধ থেকে সরালেন। কিন্তু আইনের চোখে তা সরল না। তিতাসের মৃত্যুর দায়মুক্তি তিনি পেতে পারেন না। ডিসি দায় চাপান ম্যানেজারের ওপর। এখন ফেরিঘাটের ম্যানেজার কীভাবে দায় এড়ালেন, সেটা দেখুন।

‘ডিসি স্যার ফোন দিয়ে রাতে জানান, ভিআইপি যাবেন। তবে আমি তখন ঘাটে ছিলাম না। আমাদের স্টাফকে বলে দিই ভিআইপি আসার কথা। পরে সেখানে কী হয়, তা আমার জানা নেই।’

আইনের শাসন যদি থাকত, তাহলে কী হতো? এ রকম কৈফিয়ত কারও দেওয়ার দরকার পড়ত না। ডিসি যদি নিরাপদ সড়ক চাইয়ে বিশ্বাসী হতেন, এই রাষ্ট্র যদি বিশ্বাস করত, তাহলে ফেরি মন্ত্রণালয় সংবিধিবদ্ধ নির্দেশ দিত, অ্যাম্বুলেন্সবাহী গাড়িকে কোনো অজুহাতেই আটকে বা বিলম্ব করানো যাবে না।

তাই এখন সরকারকেই ঠিক করতে হবে, ফেরি তারা কীভাবে চালাবে। তিতাসের মৃত্যু যে আগুন জ্বালিয়ে গেল, তাতে পুড়ে আমরা এবং তারা শুদ্ধ হব কি হব না।

অনাগত দিনের যুগ্ম সচিব, ফেরি ম্যানেজার ও ডিসি এবং তিতসের মা সোনামণি ঘোষের ভাষায়, সেই ‘ফেরিওয়ালারা’ মানবিক হবেন, তাঁরা অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেবেন না। প্রত্যেক ডিসির আদেশ থাকবে, কোনো অবস্থাতেই, অ্যাম্বুলেন্সের গতিরোধ করা যাবে না। এটা আন্তর্জাতিক আইনে মানবতার বিরুদ্ধেও অপরাধ।

সোনামণি ঘোষ বলেছেন, ‘আমি ফেরিওয়ালাগো পায় ধরছি, তবুও ওরা ফেরি ছাড়ে নাই। ফেরি ঠিক মতন গেলে হয়তো পোলাডা বাঁইচা যাইত।’

সরকারের কাছে তিতাস পরিবারের দুই ধরনের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আর তার চিকিৎসা নিতে বাধা তৈরি করার কারণে।

এটা তারা দেবে না। তারা অন্তত অনুশোচনা করুক। সর্বত্র তারা আদেশ জারি করুক, যাতে প্রত্যেকেই স্থিরভাবে জানেন যে বিমান, ট্রেন, জাহাজ, ফেরি চলাচলের নির্ধারিত সময়সূচি আছে। সবাই সেটা মেনে চলবে।

সুতরাং যুগ্ম সচিবেরা, ভিআইপিরা, আগ থেকেই এমনভাবে তাঁদের ভ্রমণসূচি ঠিক করবেন, যাতে তাঁদের কেউ অসময়ে ফেরি মিস করবেন না। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই তাঁরা ঘাটে থাকবেন।

এরপরও তর্কের খাতিরে যখন কেউ বলবেন, দেশটা তো ইউরোপ বানাতে পারিনি। স্থানীয় কার্যকারণ বলতে তো একটা ব্যাপার থাকবে। সেখানে এ রকম অনুরোধপ্রাপ্ত হলে ডিসি অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করবেন। তিনি প্রথমেই জেনে নেবেন এবং এ ক্ষেত্রেও উচিত ছিল, যান্ত্রিকভাবে আদেশ না দিয়ে এটা জেনে নেওয়া যে অ্যাম্বুলেন্স আছে কি না। এমন তো নয় যে অ্যাম্বুলেন্স চলাচল বিরল ঘটনা।

আমরা লক্ষ করব, এখানে একটি প্রশাসনিক শূন্যতা আছে। ডিসি বলেছেন, তিনি অ্যাম্বুলেন্সের কথা জানতেন না। জানলে কী করতেন, সেটা তিনি বলেননি। তিনি যথেষ্ট জোর দিয়ে বলেছন, ‘যুগ্ম সচিবকে ভিআইপি বলা যায়। এই ধরনের কর্মকর্তারা এই নৌপথে এলে তাঁদের বিশেষভাবে গুরুত্ব আগে থেকেই দেওয়া হচ্ছে।’ ডিসি, জনপ্রশাসন বিভাগ বা ফেরি–বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তরফে কেউ কি আছেন, যিনি ‘তিতাস হত্যাকাণ্ডের’ প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে একটা কৈফিয়ত দেবেন। বলবেন, অপেক্ষমাণ অ্যাম্বুলেন্সকে তিন ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা কেন বেআইনি নয়, কেন রাষ্ট্রকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হবে না।

তিতাস অকালপ্রয়াত হয়েছে বলে আমি এ লেখাটি লিখতে পারছি। তিতাসের যদি প্রাণ না যেত, তাহলে এটি খবরই হতো না। বিলম্বিত চিকিৎসার কারণে তার কোনো অঙ্গের স্থায়ী হানি ঘটতে পারত। তবু যদি তিতাস বেঁচে যেত, অনেক বেশি বিলম্বে ঢাকার হাসপাতালে পৌঁছানোর কারণে, যদি তার মৃত্যু হাসপাতালে ঘটত, তাহলেও ভিআইপিদের ফেরি–বিলাস কোনো খবরই হতো না।

সুতরাং আমরা কি দাবি করব যে শিশু তিতাসের ১১ বছরের জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা হলো, সে মরে গিয়ে খবরের কাগজের শিরোনাম হতে পেরেছে।

আমি কল্পনা করি, তিতাস স্বর্গ থেকেও বলছে, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক