এডিস মশা মারতে চাই টেকসই পদক্ষেপ

মশাবাহিত রোগ, যেমন ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ে প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এ সময় চলে নানা কর্মসূচি, হাতে নেওয়া হয় বড় বড় কর্মপরিকল্পনা, বৃদ্ধি হয় বাজেট। কিন্তু বছর বছর বেড়েই চলেছে এসব মশাবাহিত রোগ ও রোগীর সংখ্যা। পত্রপত্রিকার তথ্যমতে, ২০১৯ সালের জুনে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় প্রায় কয়েক গুণ বেশি। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মৌসুম ধরা হয়। সেই হিসাবে, সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মশা নিধনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, তাদের ব্যবহৃত ওষুধে মশা মরছে না। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ঢাকায় ব্যবহৃত ওষুধে মশা না মরার প্রমাণ মিলেছে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় হতে পারে, প্রথমত ব্যবহৃত কীটনাশকের পরিমাণ ও গুণগত মানে সমস্যা এবং দ্বিতীয়ত মশার মধ্যে কীটনাশক বা বালাইনাশক প্রতিরোধী সক্ষমতা তৈরি হওয়া। তাই জনস্বার্থে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে বিষয় দুটি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এ অবস্থায় মানুষকে মশার হাতে ছেড়ে দিয়ে সিটি করপোরেশন নতুন কার্যকরী ওষুধ আমদানির অপেক্ষায় থাকবে, নাকি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? অবশ্য একটি সিটি করপোরেশন বলছে, নিবন্ধন নেই এমন নতুন ওষুধের অনুমোদন নেওয়া যেহেতু একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তাই তারা বিকল্প হিসেবে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার’ অনুমোদন নিয়ে নতুন ওষুধ আমদানি করবে।

বাংলাদেশে বালাইনাশক ও মাননিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ৭৩টি উপাদান রয়েছে (ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী)। এগুলোর মধ্যে কিছু একক উপাদান এবং কিছু যৌথ উপাদান বা মিশ্রণে তৈরি। নিশ্চয়ই সব মশার বিরুদ্ধে অকার্যকর নয়। এসব অনুমোদিত বালাইনাশকের মধ্য থেকে কার্যকর বালাইনাশক খুঁজে পাওয়া জটিল কিছু নয়। তা ছাড়া আইসিডিডিআরবি ইতিমধ্যে পারমেথ্রিনের পরিবর্তে ম্যালাথিয়ন ও ডেল্টামেথ্রিন ব্যবহার করতে সুপারিশ করেছে। এর আগে ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে মশার লার্ভা (ডিম) মারতে ম্যালাথিয়ন সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ডাইমেথোয়েট, ফেনিট্রোথিয়ন, ডেল্টামেথ্রিন, ক্লোরপাইরিফসের কার্যকারিতাও দেখতে পায় তারা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্গানোফসফরাস ও পাইরিথ্রইডস গ্রুপের বালাইনাশকের বিরুদ্ধে মশার প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে ওঠার রিপোর্ট রয়েছে। আমাদের দেশে ব্যবহৃত বালাইনাশকের বিরুদ্ধে মশার প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠাও অস্বাভাবিক নয়। এ ছাড়া কৃষিকাজে পোকামাকড় দমনে অপরিমিত কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহারে মশার প্রতিরোধক্ষমতা বেড়ে গিয়ে এসব রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। তাই মশা নিধনে অবশ্যই নতুন নতুন বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।

প্রকতিতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বছরের বিশেষ সময়ে কোথা থেকে আবির্ভাব হয়, তা নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না। আমাদের প্রকৃতিতেই এসব জীবাণু তার জীবনচক্র রক্ষা করে চলেছে। মশা বংশপরম্পরায় এসব জীবাণু বহন করতে পারে, অর্থাৎ ডিমের মাধ্যমে বাচ্চাতে এসব জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাস সাধারণত মানুষ ও মশার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বানর, কুকুর, বাদুড়সহ বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীতে এর অস্তিত্ব মিলেছে। এসব প্রাণীর মাধ্যমেও এসব ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে।

সমন্বিত পদক্ষেপ

মশা ও মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে কীটতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদ, মেডিকেল ও ভেটেরিনারি পেশার ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত কমিটির মতামত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী, সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, রাজনৈতিক নেতাদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এ ছাড়া জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে পত্রপত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করতে হবে।

মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম। শুষ্ক ও আর্দ্র—উভয় মৌসুমে এডিস মশা সক্রিয় থাকে, তবে বর্ষার সময় এদের আধিক্য দেখা যায়। তাই এ সময়ে জরুরি ভিত্তিতে মশা মারতে আক্রান্ত এলাকাগুলোতে প্রয়োজনীয় কীটনাশক স্প্রে করা প্রয়োজন। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে নিয়মিত ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মশা ও অন্য রোগবাহী কীট নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি জেলায় স্থানীয় ইউনিট তৈরি করে সমন্বয়ের মাধ্যমে সারা বছর কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

 মশার প্রজনন স্থান নির্ণয় ও নির্মূল করা মশা নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকরী অংশ। এডিস মশা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে। জমে থাকা পানি পরীক্ষা করে সেখানকার মশার লার্ভা নষ্ট করতে হবে। মশার বাসস্থানের পানিতে কেরোসিন বা মবিল ঢেলে মশার প্রজনন রোধ করা যায়। তবে তা পরিবেশবান্ধব নয়। এসবের পরিবর্তে সয়াবিন বা অন্য যেকোনো সহজলভ্য তেলজাতীয় পরিবেশবান্ধব পদার্থ ব্যবহার করতে হবে। এসব পদার্থ পানির ওপরে একটি স্তর তৈরি করে মশার লার্ভাকে অক্সিজেন নিতে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে লার্ভাগুলো সহজেই মারা যায়। কিন্তু মাছ চাষের জায়গায় তেলজাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না, এতে মাছও মারা যাবে। এভাবে বাড়ির আশপাশে, পরিত্যক্ত জায়গায় বা ড্রেনের জমে থাকা পানিতে তেল ব্যবহার করে সহজেই মশার প্রজনন রোধ করা সম্ভব। ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করেও মশার লার্ভা মারা যায়।

গবেষণার বিষয়

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে কীটপতঙ্গের প্রজনন বেড়ে যেতে পারে। জলবায়ুর পরিবর্তনে পরিবর্তিত হতে পারে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের ধরন। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধিতে কোন কোন উপাদান কাজ করছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। কোন এলাকায় কোন জাতের মশা জন্ম নেয়, তার পরিষ্কার চিত্র থাকা প্রয়োজন। প্রতিবছর একবার হলেও মশা নিধনে ব্যবহৃত বালাইনাশকে মশার প্রতিরোধ সক্ষমতা তৈরি হয়েছে কি না, তা মনিটরিং করা প্রয়োজন। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে মশা ও মানুষের পাশাপাশি অন্য উত্সগুলোও খতিয়ে দেখতে হবে।

মো. সহিদুজ্জামান অধ্যাপক, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

szaman@bau. edu. bd