মানুষ বেশি হলে কার লাভ?

অতিরিক্ত জনঘনত্ব যে বাংলাদেশের অনেক সমস্যাকে প্রকট থেকে প্রকট করে তুলছে, এই বাস্তব সত্যটা আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজের নেতা–কর্মী ও সমাজ–গবেষকেরা কতটা উপলব্ধি করছেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সব উদ্যোগ বহুদিন ধরে স্থবির হয়ে আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার বা অন্য কোনো দলিলে এ প্রসঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায় না। কোনো রাজনৈতিক নেতাকে কখনো বলতে শোনা যায় না, লোকসংখ্যা অতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে, এর ফলে অনেক সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, কিছু করা দরকার। নাগরিক সমাজও এ বিষয়ে নিশ্চুপ। দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের প্রবণতা নানা ধরনের চাঞ্চল্যকর ঘটনাকে বেশি জায়গা দেওয়া, বেশি লোকের আগ্রহ নেই, এমন বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া, সে বিষয়টি জাতির যত গুরুতরই হোক না কেন।

আমরা ক্রমাগত লিখে চলেছি, অতিরিক্ত জনঘনত্ব বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় সমস্যাগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচ্য হওয়া একান্ত জরুরি। প্রথম আলোয় এ বিষয়ে লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর কিছু পাঠক ই–মেইলে এবং ফোন করে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, এ বিষয়ে যেন আরও লেখা হয়। কারণ, অতিরিক্ত জনঘনত্বের নেতিবাচক প্রভাব জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে বলে তাঁরা অনুভব করছেন। তাঁরা নিজেদের সন্তানসন্ততির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রথম আলোর এক পাঠক অনলাইনে মন্তব্য করেছেন, অতিরিক্ত জনঘনত্ব আমাদের সব সমস্যার জননী বলে তিনি মনে করেন।

এই যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেকগুলো জেলায় ডেঙ্গুর বিস্তার চলছে, বিশেষত রাজধানীর সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল–ক্লিনিকগুলোতে রোগীর ভিড় বেড়েই চলেছে; ‘আমার বাচ্চাটার ডেঙ্গু হলে কোনো হাসপাতালে যদি সিট না পাই?’—এ উদ্বেগ এখন অনেকের মনে। চিকিৎসক, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ব্যবস্থাপকদের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। জনঘনত্বের চাপ কি টের পাওয়া যাচ্ছে না? এমনিতে স্বাভাবিক অবস্থাতেই দেশের হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি রোগীর ভিড় লেগে থাকে। মেঝেতে, করিডরে, সিঁড়ির কোণে কোণে রোগীদের গড়াগড়ি খেতে হয়। রোগীর সংখ্যার তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা হতাশাব্যঞ্জকভাবে কম, নার্সের সংখ্যা আরও কম; পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কথা বলাই বাহুল্য—হাসপাতাল–স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর টয়লেটের দুর্গন্ধে রোগীদের আরোগ্যের বদলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ার দশা।

বলা হতে পারে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কারণে এক বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু এ রকম বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়াও কি সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে জনঘনত্বের চাপ টের পাওয়া যায় না? যায়। ভুক্তভোগী সবাই তা টের পায়। যাদের অনেক টাকা আছে, সর্দি–কাশি হলেই যারা ব্যাংকক–সিঙ্গাপুর, দিল্লি–চেন্নাই ছোটে, তাদের কথা অবশ্য ভিন্ন।

শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, শিক্ষা, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, রাস্তাঘাট, যানবাহন, দোকানপাট, হাটবাজার—সবখানে অতিরিক্ত জনঘনত্বের চাপ ক্রমেই আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ঘরবাড়ি বাড়তে বাড়তে একটা গ্রাম আরেকটা গ্রামের সঙ্গে জোড়া লেগে যাচ্ছে। অর্থাৎ কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। নদী–নালা, খাল–বিল, পুকুর–ডোবা ভরাট করে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল–কলেজ–মাদ্রাসা তৈরি হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পাহাড়–টিলা কেটে, বনজঙ্গল উজাড় করে ক্রমবর্ধমান মানুষের জীবন–জীবিকার সংগ্রামের সম্প্রসারণ চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সড়ক–মহাসড়কে যানবাহন উপচে পড়ছে, তাই সেগুলো সম্প্রসারণ করা দরকার; নতুন নতুন সড়ক, মহাসড়ক, সেতু, কালভার্ট বানানো দরকার; আরও অনেক কলকারখানা স্থাপন করা দরকার। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যবসা–বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটাতেই হবে, তা করতে গিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ভীষণভাবে উল্টেপাল্টে গেলেও পিছু হটার কোনো উপায় থাকবে না। কারণ, মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

মোদ্দা কথা, মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে সবকিছুই আরও বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশটার আয়তন খুবই কম: ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গায় ১৭ কোটি মানুষ বাস করলে এবং সেই মানুষেরা সামষ্টিক কল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তিগত ভাগ্যোন্নয়নের তাড়নায় ছুটতে থাকলে, তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির মূলমন্ত্র আত্মপরতা হলে তাদের দেশ নামক ভূখণ্ডটি শুধু প্রাকৃতিকভাবে বিপর্যস্তই হয় না, তাদের রাষ্ট্র,
সমাজ, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছুতে বৈকল্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

মানুষের সংখ্যার তুলনায় সম্পদের ঘাটতির প্রসঙ্গ তুললে এই লেখা অনেক লম্বা হয়ে যাবে। সংক্ষেপে এটুকু বলে রাখা যাক, আমরা সংখ্যায় অতিরিক্ত হয়ে গেছি বলেই আমাদের সবকিছুতেই ঘাটতি পড়ে যাচ্ছে: চিকিৎসকের ঘাটতি, শিক্ষকের ঘাটতি, প্রকৌশলীর ঘাটতি, কৃষিবিদের ঘাটতি। ঘাটতি কোথায় নেই? ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, আমাদের সম্পদ সীমিত। একটা উদাহরণ দিই: আমাদের দেশে গড়ে ৬ হাজার ৫৭৯ জন চিকিৎসাপ্রার্থীর জন্য আছেন মাত্র ১ জন চিকিৎসক। শ্রীলঙ্কায় এই অনুপাত ১ : ৬৭১। তাদের অবস্থা আমাদের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ ভালো এ কারণে যে তাদের মোট জনসংখ্যা আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম (মাত্র ২ কোটি ১৩ লাখ)। আমরা চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়াতে পারছি না। কারণ, আমাদের পর্যাপ্ত অর্থ নেই। শিক্ষাসহ জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব খাতেই লোকবলের ঘাটতির প্রধান কারণ সম্পদের সীমাবদ্ধতা (জাতীয় স্বার্থে অগ্রাধিকার নির্ধারণে আন্তরিকতার অভাবও উল্লেখ্য)।

এ পর্যন্ত যাকিছু বলা হলো, সবই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়। অতিরিক্ত জনঘনত্বের নেতিবাচক প্রভাব না বোঝার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারক, রাজনৈতিক দলগুলো, ব্যবসায়ী–শিল্পপতি সমাজের কোনো অংশেই কেন এ সমস্যার কথা উচ্চারিত হতে শোনা যায় না? আন্তর্জাতিক মহল, যারা একটা সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর ভীষণ জোর দিয়েছিল, তারাও কেন নীরব হয়ে গেছে? কেন আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে?

একটা কারণ স্পষ্ট: সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, বড় জনসংখ্যা হলো বড় সম্পদ। এ অর্থে কথাটা ঠিক যে বেশি মানুষ মানে বেশি শ্রমশক্তি। অর্থনীতিবিদদের একটা অংশ বলে, জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সহায়ক। বেশি মানুষ মানে বেশি ক্রেতা, বেশি ক্রেতা মানে বেশি মুনাফা। সুতরাং পাড়ার সবচেয়ে ছোট মুদিদোকানদার থেকে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবাই চায় আরও বেশি লোক, আরও বেশি ক্রেতা। হাসপাতাল–ক্লিনিকে রোগীর ভিড় যত বেশি হবে, তাদের আয় তত বেশি বাড়বে (চিকিৎসার মান কমলে তাদের কিছু আসে–যায় না)।

মানুষের সংখ্যা বেশি হলে শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ে। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই তখন শ্রম সস্তা হয়ে যায়। যারা শ্রম কেনে, এটা তাদের জন্য খুব লাভজনক ব্যাপার। কিন্তু যাদের শ্রম বিক্রি করে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়, তাদের সংগ্রাম আরও প্রাণান্ত হয়ে ওঠে। তাদের জীবনযাত্রার মান পড়ে যায়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের সমৃদ্ধি ও প্রসারের প্রধান কারণ খুব সস্তা শ্রম। এ দেশে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন শ্রমিকের মাসিক বেতন ১০৮ ডলার, মিয়ানমারে ১৬২ ডলার, ভারতে ২৬৫ ডলার, পাকিস্তানে ১৮৭ ডলার, কম্বোডিয়ায় ২০১ ডলার।

শুধু গায়ে–গতরে খাটা শ্রমিকের নয়, বাংলাদেশের সব খাতের শ্রমই বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় সস্তা। জাপানের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) এ বছরের মার্চ মাসে এক জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। ওই জরিপে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৯টি দেশের উৎপাদনশীল খাতের শ্রমিক, প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপক এবং সেবা খাতের ব্যবস্থাপক ও কর্মীদের মাসিক ও বার্ষিক বেতনের চিত্র তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা যায়, ওই ১৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশে প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকদের বেতন সবচেয়ে কম। বাংলাদেশে উৎপাদনশীল খাতে প্রকৌশলীদের মাসিক বেতন ২৮৭ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ২৯১ ডলার, মিয়ানমারে ৩৪৯ ডলার, পাকিস্তানে ৪৯২ ডলার ও ভারতে ৫৯১ ডলার। উৎপাদনশীল ও সেবা খাতের ব্যবস্থাপকদের বেতনের দিক দিয়েও বাংলাদেশের অবস্থান একদম নিচে।

কারণটা বোঝা খুব কঠিন নয়। এ দেশে লাখ লাখ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণ–তরুণী চাকরির জন্য মরিয়া হয়ে ছোটে বলেই চাকরিদাতারা তাদের কিনতে পারে অতি সস্তায়। যারা চাকরি পায়, তারা তা পেয়েই ধন্য হয়ে যায়। কত সস্তায় তাদের কেনা হলো, তা তারা ভাবার ফুরসত পায় না।
পেলেও ভেবে কোনো লাভ নেই। কারণ, চাকরির বাজারের নিয়মে তারা সস্তা। দর–কষাকষির সুযোগ তাদের নেই।

শুধু অর্থনীতির বিচারেই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির বিচারেও অতিরিক্ত জনসংখ্যা প্রায় সব দলের জন্য সুবিধাজনক। বরাবরই সমাজের যে শ্রেণির জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে বাড়ছে, তারা দরিদ্র, শিক্ষাবঞ্চিত, ক্ষমতাহীন মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে তাদের ব্যবহার করা অপেক্ষাকৃত সহজ।

সমাজের সব মানুষ শিক্ষিত ও অধিকার–সচেতন নাগরিক হয়ে উঠলে তাদের নিয়ে নিজেদের মতলব হাসিলের রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়বে; শুধু মুখের কথায় তাদের মন ভোলানো যাবে না, তাদের কল্যাণের জন্য কাজও করতে হবে। তাদের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের ভোট নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে তারা চোখকান বুজে তাদের শাসন–শোষণ সহ্য করবে না। তারা চোখের সামনে জনপ্রতিনিধিদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার পথে বাধার পাহাড় গড়ে তুলবে। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভু মানবে না, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মনে করে তাদের কাছ থেকে সেবা আদায় করে নেবে। তারা প্রশ্ন করবে, জবাবদিহি চাইবে; তারা অনিয়ম–দুর্নীতির প্রতিবাদ জানাবে, অপশাসন–দুঃশাসন প্রতিরোধ করবে। যেসব রাজনৈতিক দল মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা বলে, তাদেরও দারিদ্র্যপীড়িত, শিক্ষা–স্বাস্থ্য–বাসস্থানের সুবিধাবঞ্চিত বিপুল জনগোষ্ঠী দরকার; প্রলেতারিয়েত আর লুম্পেন যত বাড়বে, সেসব দলের কাঙ্ক্ষিত বৈপ্লবিক পরিস্থিতি ততই ঘনিয়ে আসবে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র ও সমাজে যেসব শক্তি ও গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব আছে, অতিরিক্ত জনসংখ্যা তাদের জন্য সমস্যা তো নয়ই, বরং লাভজনক ব্যাপার। নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার্য জিনিস সস্তায় ও সহজে যত বেশি মেলে, ততই সুবিধা, ততই লাভ।

কিন্তু এই গোষ্ঠীগত লাভ ও সুবিধা যে টেকসই হওয়ার নয়, তা যদি আমরা উপলব্ধি না করি, তবে তা হবে বিরাট অপরিণামদর্শিতা। সামনে বিপদ। সবার জন্যই।

মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]