মানুষের মনে তিন ভয় - ডেঙ্গু, যানজট ও ট্রেনের সূচি বিপর্যয়

ডেঙ্গু জ্বরে ১৫ দিন ধরে ভুগছে ছয় বছরের শিশু মুশনান। হাসপাতালের মশারিঘেরা বিছানাটিই তার এখন পুরো জগৎ। আছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা। পায়ে ছবি এঁকে সময় কাটাচ্ছে সে। সম্প্রতি শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু সেলে। ফাইল ছবি
ডেঙ্গু জ্বরে ১৫ দিন ধরে ভুগছে ছয় বছরের শিশু মুশনান। হাসপাতালের মশারিঘেরা বিছানাটিই তার এখন পুরো জগৎ। আছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা। পায়ে ছবি এঁকে সময় কাটাচ্ছে সে। সম্প্রতি শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু সেলে। ফাইল ছবি

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা শহরে যেসব রোগী ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মগবাজারের বাসিন্দা তুলনামূলক বেশি। মগবাজারের একজন বাসিন্দা হিসেবে এই খবরে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। ঢাকা শহরে এত এলাকা থাকতে মগবাজারকে এডিস মশা কেন বেছে নিল, সেসব নিয়ে ভবিষ্যতে বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে দেখবেন। তবে এই মুহূর্তে ঢাকার সব বাসিন্দা তো বটেই মগবাজারবাসীর কাছে অনুরোধ থাকবে, তাঁরা যেন তাঁদের ঘরবাড়ি, গ্যারেজ, বাগান, দোকানপাট, এলাকার স্কুল-কমিউনিটি সেন্টার পরিচ্ছন্ন রাখেন। কোথাও পানি জমতে না দেন। বিশেষ করে ঈদের তিন দিন শহর পরিচ্ছন্ন রাখা অত্যন্ত জরুরি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বলেছে, নির্ধারিত স্থানে পশু জবাই করলে প্রয়োজনে তাঁরা বাড়িতে মাংস পৌঁছে দেবেন। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার আগে কী কী করণীয়, সে সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি নির্দেশিকা দিয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। আগে বাড়িঘরের নিরাপত্তা সম্পর্কে নির্দেশনা দিত। এখন এডিস মশা সম্পর্কে নির্দেশনা দিচ্ছে। এডিসের ভয়ে বোধ করি চোর-ডাকাত সব পালিয়েছে।

প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় পাঁচ হাজার ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। আবার জায়গার অভাবে অনেকে ভর্তি হতে পারেননি। বাসাবাড়িতে চিকিৎসা হচ্ছে। গতকাল রংপুর থেকে একজন চিকিৎসক টেলিফোন করে জানান, শুধু হাসপাতাল নয়, মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁরা এই কষ্ট করতে রাজি আছেন। তিনি আরও বললেন, ডেঙ্গুর তো আসলে কোনো চিকিৎসা নেই। ডেঙ্গুর উৎস নির্মূল করেই এই রোগ তাড়াতে হবে। কলকাতা সিটি করপোরেশনের ডেপুটি মেয়রও তা-ই বলেছেন। তবে কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তাঁকে পুরো বিশ্রামে থাকতে হবে এবং স্যালাইন নিতে হবে। সিটি করপোরেশনের কর্তা ব্যক্তিরা নগরবাসীকে আশার ছলনে না ভুলিয়ে দ্রুত যদি যে ওষুধে এডিস মশা মরবে, সেই ওষুধ আগে ভাগে নিয়ে আসত, তাহলে মানুষকে এতটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হতো না। সর্বশেষ খবর হলো ঢাকায় ডেঙ্গুর উপদ্রব কিছুটা কমলেও ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। ঈদে অনেকে গ্রামের বাড়িতে যাবেন, ঈদের পর ফিরে আসবেন। কেউ ট্রেনে, কেউ বাসে বা কেউ লঞ্চের আরোহী হবেন কিংবা হয়েছেন। সবাই যাতে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন, পথে কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হন, সে জন্য সব পরিবহন পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

এবারের ঈদ এসেছে অনেকগুলো প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ নিয়ে। বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও ডেঙ্গু মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। আমরা আগে থেকে সতর্ক থাকলে এটি মোকাবিলা করা কঠিন হতো না। পরিবহন দুর্ঘটনা আরেকটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। ঈদের আগে পরিবহন বিশেষ করে সড়ক পরিবহন নিয়ে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেল।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতারা শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, সড়কপথে অব্যবস্থাপনার কারণে ঈদে ঘরমুখী মানুষদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে। ফিটনেসবিহীন ট্রাকে পশু বহন, ফিটনেসবিহীন বাসে যাত্রী পরিবহনে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। রেলপথে টিকিট কালোবাজারি, ছাদে যাত্রী ও শিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে। লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ফেরিঘাটে যাত্রীদের বসে থাকতে হচ্ছে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, এই ঈদে ঢাকা থেকে ১ কোটি ৫ লাখ যাত্রী অন্য জেলায় যাতায়াত করবে। আর দেশব্যাপী এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাতায়াত করবে আরও ৩ কোটি ৫০ লাখ যাত্রী। এবারের ঈদযাত্রার ১২ দিনে ৪ কোটি ৫৫ লাখ যাত্রী বিভিন্ন পথে যাতায়াত করবে।

ট্রেনে আনন্দের ঈদযাত্রা দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। ট্রেনের সময়সূচি ভেঙে পড়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব ট্রেনে সর্বোচ্চ ১২-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্ব হবে। এ পরিস্থিতিতে ঈদের আগে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পথে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে রেলের কর্মকর্তারা মনে করছেন। কমলাপুর, ঢাকা, ১০ আগস্ট। ছবি: হাসান রাজা
ট্রেনে আনন্দের ঈদযাত্রা দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। ট্রেনের সময়সূচি ভেঙে পড়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব ট্রেনে সর্বোচ্চ ১২-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্ব হবে। এ পরিস্থিতিতে ঈদের আগে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পথে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে রেলের কর্মকর্তারা মনে করছেন। কমলাপুর, ঢাকা, ১০ আগস্ট। ছবি: হাসান রাজা

কিন্তু সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যাত্রী কল্যাণ সমিতির এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, এবার ঈদযাত্রায় যানবাহন ধীরগতিতে চললেও কোথাও যানজট নেই। যানবাহনের ধীরগতির কারণ হিসেবে তিনি মহাসড়কে উচ্চগতির পাশাপাশি ধীরগতির বাহন চলাচল, মহাসড়কে নিয়মিত চলাচল করে না—এমন গাড়িগুলোর রাস্তায় নামা ও দুর্ঘটনায় পড়াকে দায়ী করেছেন। কিন্তু তিন ঘণ্টার পথ যেতে যদি ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লাগে, তাকে কোনোভাবে ধীরগতি বলা যায় না।

গত ঈদের মতো এবারও নিরাপদ ট্রেনযাত্রা সবচেয়ে অনিরাপদ বাহনে পরিণত হয়েছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, রেলের পশ্চিমাঞ্চলে ট্রেনের সময়সূচি ভেঙে পড়েছে। এসব ট্রেনে সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা আছে। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত খুলনা, রাজশাহী, রংপুর বিভাগে ট্রেন সর্বোচ্চ সাড়ে নয় ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে ছেড়েছে। শুক্রবার থেকে এখন পর্যন্ত পশ্চিমাঞ্চলগামী যমুনা সেতু পার হয়ে যেসব ট্রেন ঢাকা ছাড়ে, শনিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত সেসব ট্রেনের কোনোটি স্টেশনে এসেই পৌঁছায়নি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের পুরো প্ল্যাটফর্মে মানুষ শুয়ে–বসে অবস্থান করছেন।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে দিনে ৭৩টি আন্তনগর ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৮টি ট্রেন দেরিতে ঢাকা ছাড়ে। এর মধ্যে লালমনিরহাট স্পেশাল সর্বোচ্চ ৯ ঘণ্টা ২৫ মিনিট দেরি হয়। রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন সাত ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। বাকি সব ট্রেনই পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা করে দেরিতে ছাড়ে। ২৪টি ট্রেন ঢাকা থেকে সময়মতো ছেড়ে যায়। এর বেশ কয়েকটি পথে আটকা পড়ে কয়েক ঘণ্টা দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছায়।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ধীরগতিতে চলছে যানবাহন। পাটুরিয়া ঘাট, মানিকগঞ্জ, ১০ আগস্ট। ছবি: আব্দুল মোমিন
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ধীরগতিতে চলছে যানবাহন। পাটুরিয়া ঘাট, মানিকগঞ্জ, ১০ আগস্ট। ছবি: আব্দুল মোমিন

শনিবার সদরঘাট টার্মিনালে দেখা যায়, সকাল থেকে দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল, ভোলা, হাতিয়া, মনপুরা, চাঁদপুর, বরগুনা, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলার ঘরমুখী যাত্রীরা ভিড় করছেন লঞ্চঘাটে। টার্মিনালে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। পন্টুনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। যাঁদের লঞ্চ বিকেলে বা সন্ধ্যায়, তাঁরাও টার্মিনালে আসেন দুপুর ১২টার পর থেকে। টার্মিনাল, পন্টুন, লঞ্চে যাত্রী আর যাত্রী। পন্টুনে ভিড় থাকায় অনেকেই নৌকায় করে লঞ্চে ওঠেন। তবে লঞ্চের নির্দিষ্ট সময় না থাকায় পন্টুনে যাত্রীদের শুয়ে-বসে থাকতে দেখা গেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যাত্রীদের অভিযোগ, দক্ষিণাঞ্চলের কিছু রুটে ঈদ উপলক্ষে লঞ্চের সংখ্যা বাড়ালেও অনেক রুটে আগের সময়সূচি অনুযায়ী লঞ্চ না ছাড়ায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের।

সড়কমন্ত্রী আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু কথা বললেও রেলওয়ে ও নৌপরিবহন মন্ত্রী নীরব। কিছুদিন আগে কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে রেলওয়ে মন্ত্রী বলেছিলেন, সড়কপথ বন্ধ থাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ ট্রেনে উঠেছে বলে রেল সেতু ভেঙে পড়েছে। আমাদের সংস্কৃতি হলো কেউ নিজের দোষ স্বীকার করতে চান না। মন্ত্রী নিশ্চয়ই নিজে ট্রেন চালান না বা লাইন ঠিক করেন না। এসব যাঁরা করেন, তাঁদের জবাবদিহি আদায় করা তাঁর কাজ। কিন্তু তিনি যদি তাঁদের অপরাধ ঢাকতে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে দুর্ঘটনা কিংবা সময়সূচি বিপর্যয় ঘটতেই থাকবে।

ঈদের আগাম শুভেচ্ছা সবাইকে।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]