চামড়া নিয়ে কামড়াকামড়ির দিন শেষ

সড়কের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোরবানির পশুর চামড়া। ১৩ আগস্ট, চট্টগ্রাম, আতুরার ডিপো
সড়কের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোরবানির পশুর চামড়া। ১৩ আগস্ট, চট্টগ্রাম, আতুরার ডিপো

তখন ‘জুতা আবিষ্কার’-এর আগের জমানা। ‘আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি, রাজ্যে মোর এ কী অনাসৃষ্টি!’—বলে হবু রাজা চেঁচামেচি করছিলেন। রাজার পায়ে যাতে ধুলো না লাগে, সেই কায়দা বের করতে পণ্ডিতেরা ‘উনিশ পিপে নস্য’ খরচ করে যে কয়টা প্ল্যান বের করলেন, তার একটা হলো ‘চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী’। পরে দেখা গেল ধুলার হাত থেকে পা বাঁচানোর জন্য রাস্তাঘাট মুড়ে দেওয়ার মতো ‘না মিলে তত উচিত-মতো চর্ম’। এই পণ্ডিতগুলো যদি দাঁত কিড়িমিড়ি দিয়ে ধৈর্য ধরে এবারের কোরবানির ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন, তাহলে চামড়ার অভাব পড়ত না। কোনো টাকাপয়সার দরকার ছিল না। চট্টগ্রামের রাস্তায় এক বেলা চামড়া কুড়ালেই হয়ে যেত। শুধু চট্টগ্রাম নয়, বাংলার বহু হাটে মাঠে বাটে এবার যে পরিমাণ পরিত্যক্ত চামড়ার সমাগম দেখা গেছে, তা দিয়ে হবু রাজার সব রাজপথ মুড়িয়ে দেওয়া যেত। 

আগে গেরস্তের দামড়া গরু মরলে সেই মরা গরুর চামড়া নেওয়ার জন্য চর্মকারদের মধ্যে কামড়াকামড়ি লেগে যেত। চর্মকার মরা গরু নিয়ে যাওয়ার সময় ‘খুশি হয়ে’ গেরস্তের হাতে শখানেক টাকা গুঁজে দিতেন। এখন দিন বদলেছে। এখন সেই চামারও নেই, চামড়ার সেই ডিমান্ড নেই। 

অন্য সব বছরের মতো এ বছরও মহল্লার ছেলেপেলে ‘টু পাইস’ কামানোর আশায় কোরবানির চামড়া সংগ্রহে বাড়ি বাড়ি গিয়েছিল। আড়তদারেরা বেশি দাম দেবেন না—এই আশঙ্কা আগেই ছিল। সেই কারণে যে গরুর দাম লাখ টাকা, সেই গরুর চামড়া তাঁরা গৃহস্থের কাছ থেকে কিনেছিলেন তিন– চার শ টাকায়। চামড়াপ্রতি শ দুই–তিনেক টাকা লাভ থাকবে এমন আশা ছিল। অনেকেই ধারদেনা করে তিন–চার লাখ টাকার চামড়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করেছিলেন। পরে দেখা গেল, আড়তদারেরা ‘চোখ পাল্টি’ দিয়েছেন। তাঁরা বললেন, রাখার জায়গা নেই, কেনা যাবে না। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাথায় বাজ পড়ল। তাঁরা আড়তদারদের হাত–পায়ে ধরাধরি শুরু করলেন। যে আড়তদারের দিলে বেশি রহম, তিনি তিন শ টাকার চামড়ার দাম হিসাবে পঞ্চাশ টাকা দিতে রাজি হলেন। মনের দুঃখে চামড়া রাস্তায় ফেলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। 

শুধু চট্টগ্রামেই এবার লোকজন এক লাখের বেশি চামড়া রাস্তায় ফেলে গেছেন। সেই চামড়ার পচা গন্ধে লোকজনের দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। তাই সাফ করতে গিয়ে সিটি করপোরেশনের ঘাম বেরিয়ে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জ, বরিশাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বেশ কিছু জায়গায় শত শত চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। 

পুরো ঘটনা থেকে আমরা তাহলে কী শিখলাম? শিখলাম, বাংলাদেশ চামড়ায় শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ না, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আমরা শিখলাম, আড়তদার ও ট্যানারির মালিকেরা মনে করতে শুরু করেছেন, এই জিনিস রপ্তানি করা আর ‘ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করা’ একই কথা। তাই এত কম পয়সার কাজ তাঁরা ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা আরও শিখলাম, কোরবানির পশুর চামড়া ডাম্পিং করার জন্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো আগামী ঈদের আগেই বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়া উচিত। সেই প্রকল্পের আওতায় চামড়া পচিয়ে জৈব সার উৎপাদন করলে আমরা তা ব্যবহার করে বাড়ির ছাদে উচ্চমাধ্যমিক ফলনশীল বিটি বেগুন চাষ করতে পারব। 

চামড়া পচানোর প্রকল্প বহু আগেই হাতে নেওয়া উচিত ছিল। সরকারের বোঝা উচিত ছিল, চামড়ার দামের ধস নতুন কোনো ঘটনা নয়। এই শিল্পে তাইরে-নাইরে চলছে অনেক আগে থেকেই। আড়তদারেরা বলছেন, চামড়া কিনবেন কেমন করে? এই চামড়া নিয়ে তাঁদের বিক্রি করতে হবে ট্যানারিতে। গত বছর ট্যানারিতে চামড়া দেওয়ার পর সেই দামই এখনো তাঁরা পাননি। নতুন করে পুঁজি খাটিয়ে আবার বাকিতে মাল দেবেন কী করে? ট্যানারির মালিকেরা বলছেন, হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে ট্যানারি সরানোর কারণে রপ্তানি করতে পারেননি। সেই কারণে আড়তদারদের আগের পাওনা দিতে পারেননি। তাঁরা আরও বলছেন, চামড়ার দর ফেলে দেওয়ার পেছনে আড়তদারদের হাত আছে। আগতদারেরাই চক্রান্ত করে চামড়া কেনেননি। ট্যানারির মালিক ও আড়তদারেরা পরস্পরকে দুষলেও অন্তত এই একটি বিষয়ে তাঁরা একমত হয়েছেন যে এ বছর প্রায় আড়াই শ কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হবে। 

হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতির গল্প শুনতে শুনতে পাবলিক এখন আর দুই শ বা আড়াই শ কোটি টাকার ক্ষতির কথা শুনে রি–অ্যাকশন দেয় না। হয়তো সেই কারণেই সরকারের দিক থেকেও এ নিয়ে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। ঈদের আগে সরকার চামড়ার যে দাম ধরে দিয়েছিল, তার ধারেকাছেও ব্যবসায়ীরা যাননি। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে যখন ধান–চালই বিক্রি হয় না, তখন চামড়ার ব্যবসায়ীদের আর কী দোষ? 

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক