জনশুমারিতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কোথায়

জনশুমারিতে বাংলাদেশের নারী ও পুরুষের সংখ্যা ও অনুপাত প্রকাশ করা হয়, কিন্তু নারী ও পুরুষের বাইরে যারা আছে, তাদের কোনো পরিসংখ্যান কখনোই আমরা পাই না। শুমারি থেকে তারা বরাবরই বাদ পড়ে যায়। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে প্রথমবারের মতো নারী ও পুরুষের বাইরে পৃথক লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভালো সিদ্ধান্ত। এর ফলে তারা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়ে পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকাসহ বিভিন্ন সনদ, ফরমে নাম লিখতে পারবে। 

তবে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা শুধু ‘হিজড়া’ নয়, তাদের মধ্যে ‘রূপান্তরিত নারী’ বা ‘ট্রান্সউইম্যান’, ‘রূপান্তরিত পুরুষ’ বা ‘ট্রান্সম্যান’, ‘ইন্টারসেক্স’, ‘রূপান্তরকামী’, ‘ট্রান্সসেক্স’, ‘সজ্জাকামী’, ‘বৃহন্নলা’—এমন নানা বৈচিত্র্যময় লিঙ্গীয় পরিচয়ের মানুষ আছে। বলা হয়, ‘হিজড়া’ শব্দটি প্রচলিত ব্যঞ্জনা নেতিবাচক, হয়তো–বা অবমাননাকরও। সব লিঙ্গের মানুষের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে নারী ও পুরুষের বাইরে কমন পরিচিতিমূলক শব্দ হিসেবে ইংরেজিতে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ আর বাংলায় ‘রূপান্তরিত লিঙ্গ’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করা যায় কি না, ভেবে দেখা যেতে পারে। 

বাংলাদেশের ‘রূপান্তরিত লিঙ্গের’ মানুষের আছে দুই শতাধিক বছরের ইতিহাস। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে ‘রূপান্তরিত লিঙ্গের’ জনগোষ্ঠী সামাজিকভাবে বর্জিত—সোশ্যালি এক্সক্লুডেড। এদের জীবনযাপন দরিদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। তাদের কর্মসংস্থান নেই। তারা দোকানপাট ও ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, খ. বিত্তবানদের বাড়িতে নেচে-গেয়ে বিনিময়ে অর্থ নেয়, গ. বাধাই বা নবজাতককে আশীর্বাদ করার বিনিময়ে দান গ্রহণ করে, ঘ. কেউ কেউ যৌনকর্মী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা স্বাস্থ্য ও চিকিত্সা, বাসস্থান, শিক্ষা, চাকরি, অভিবাসন, আইনি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। দেশে তাদের মোট সংখ্যা কত, কেউ জানে না। কেউ বলে ১০ হাজার, কেউ বলে ১ লাখের বেশি। কিন্তু এসব অনুমান কোনো কাজের কথা নয়। তাদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করার জন্য জনশুমারিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

বহুত্ববাদী সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংস্কৃতির পারস্পরিক সহাবস্থান থাকে, থাকে বৈচিত্র্য, একে অপরের প্রতি সম্মান, মর্যাদা ও শ্রদ্ধাবোধ। বিবিএস এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী গোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে জরিপের উদ্যোগ নিলে সেখানে একটি মিক্সড গ্রুপ এক্সপার্ট রাখা দরকার, যাদের কাজ হবে শুমারিতে এদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে একটি ফাংশনাল ডেফিনেশন তৈরি করে দেওয়া। সেখানে অবশ্যই মনোবিজ্ঞানী এবং তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পৃথিবীর অন্যত্র কীভাবে এই জনগোষ্ঠীর শুমারি করা হয়, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোও জরুরি। 

বিশেষ একটি জনগোষ্ঠীর বিদ্যমান অবস্থা বিবেচনা করে তাদের কল্যাণে কোনো জাতীয় পরিকল্পনা বা সময়সীমাভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তাদের সঠিক সংখ্যা জানা অপরিহার্য। নইলে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাজেটের পরিমাণ ঠিক করাও সম্ভব নয়। এ নিয়ে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির উদ্যোগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে কয়েকটি সভা হয়, সেগুলোতে থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেসব সভা থেকে এ জনগোষ্ঠীর ওপর একটি সার্বিক শুমারি কেন জরুরি, তা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, একটি জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা জানা গেলে, তাদের জন্য রাষ্ট্রের সম্পদ যথাযথভাবে বণ্টনের সুযোগ বৃদ্ধি পায়; শুমারির মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিশু, তরুণ ও বয়োবৃদ্ধের সংখ্যা ও অনুপাত জানা যায়; এর ফলে প্রতিটি অংশের বিশেষ প্রয়োজন বোঝা ও সে অনুযায়ী বাস্তবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়। শুমারির ফলে এই জনগোষ্ঠীর বিশেষ চাহিদা (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, জীবিকা ইত্যাদি) নিরূপণ ও সে মোতাবেক পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব হয়। বাংলাদেশের কোন জেলায় কতজন ‘রূপান্তরিত লিঙ্গের’মানুষ বাস করে, তা জানা যাবে এবং সে অনুযায়ী জেলাভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও সময়সীমাভিত্তিক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কৌশল গ্রহণ করা সম্ভব হবে। আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তারা যে বৈষম্যের শিকার হয়, তার প্রকৃত চিত্র বোঝা সম্ভব হবে। 

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ‘রূপান্তরিত লিঙ্গের’ মানুষের জন্য যে বয়স্ক ভাতা চালু করা হয়েছে, শুমারি হলে তার সঠিক বাস্তবায়ন হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও জীবিকা উন্নয়নের লক্ষ্যে যেসব প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে, তা আরও ফলপ্রসূ হবে। সমাজের মূলধারায় তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি নির্মাণে সরকার, গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থাগুলো সীমিত আকারে হলেও যে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড ও অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম চালাচ্ছে, তা আরও কার্যকর হবে। তাদের কর্মসংস্থানের আওতা নির্ণয় এবং তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা সহজতর হবে। বছরওয়ারি কতজন ‘রূপান্তরিত লিঙ্গের’ মানুষের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে মূলধারায় আনা সম্ভব হলো এবং আরও কতজন বাদ রয়ে গেল, তা জানা যাবে। তবে জোরজবরদস্তি বা কোনো অসম্মানজনক পন্থায় নয়, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই শুমারি করা উচিত। 

রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী মহলে ‘রূপান্তরিত’ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ নিয়ে বিশদ ও আন্তরিক আলোচনা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতিশ্রুতি যে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিংবা জাতিসংঘের এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের যে ম্যান্ডেট, সেটা বাস্তবায়নের জন্যও উন্নয়নের মূল স্রোতে ‘রূপান্তরিত লিঙ্গের’ মানুষদের যুক্ত করা খুবই জরুরি। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাদ যাবে না কেউ—এই হোক আমাদের উন্নয়ন দর্শন। বাংলাদেশ একটি বহুজাতি, বহু ধর্ম, বহু ভাষা ও বহুলিঙ্গ ও বহুসংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনায় ও সংবিধানের ধারায় এই বহুত্ববাদী নীতির প্রতিফলন থাকতে হবে। এই বহুত্ববাদই গণতন্ত্রের আসল সৌন্দর্য। কাজেই রাষ্ট্রকে কেবল ধর্মনিরপেক্ষ হলেই চলবে না, একে একই সঙ্গে জাতিনিরপেক্ষ, ভাষানিরপেক্ষ, লিঙ্গনিরপেক্ষ ও যৌনতানিরপেক্ষ হতে হবে। সেই রকম একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠনের আত্মম্ভর আশা আমাদের সবার। 

রোবায়েত ফেরদৌস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক