বন তুই ব্রহ্মপুত্রের বইন

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আমাদের ঈশ্বর থাকেন জঙ্গলে, মাঠে এবং বৃষ্টি এলে থাকেন পাহাড়ে-পর্বতে—কথাগুলো লাতিন আমেরিকার এক অরণ্যচারী একজন মিশনারিকে বলেছিলেন। আজ ব্রহ্মপুত্রের কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা জেলার অংশে বিরান মাঠ আছে, ওপারে পাহাড়। কিন্তু জঙ্গল নেই, তবে ছিল ১০০ বছর আগে। এখনো আছে ৫৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে উজানে ভারতীয় অংশে। কাজী রাঙা রাষ্ট্রীয় উদ্যান, মানস রাষ্ট্রীয় উদ্যান, বড়নদী অভয়ারণ্য, ওরাং ন্যাশনাল পার্ক, লাউখোয়া অভয়ারণ্য, পবিতরা অভয়ারণ্য, সোনাই-রূপাই অভয়ারণ্য, নামেরী ন্যাশনাল পার্ক, ডিব্রু সাইখোয়া ন্যাশনাল পার্কসহ কত নামের বন। সেই সব বনের কত অভিজ্ঞতা বয়ে এনেছেন আমাদের পিতৃগণ। 

 ১৯১১ সালের আসাম-বেঙ্গল গেজেটিয়ারে তৎকালীন বৃহত্তর রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার ব্রহ্মপুত্রের জঙ্গল সম্পর্কে বলা হয়েছে, বান এলে জঙ্গল পানিতে ঢেকে যেত। প্রচুর উঁচু নলখাগড়া পশ্চিম অংশে তর পুবে লম্বা ঘাসে ভর্তি। ছিল আবাদের জন্য খোলা জায়গা আর বৈচিত্র্যময় বাঁশ, খেজুরগাছ, আমের বাগান ও নানান জাতের গাছের ঝোপ। কখনো কখনো ব্রহ্মপুত্রের চরগুলোতে শূকর ধরতে বাঘ নেমে আসত। ১৯০৮ সালে একটি ও ১৯০৯ সালে এক জোড়া বাচ্চাসহ একটি বাঘ দম্পতি কোচবিহারের দিকে ভূরুঙ্গামারীতে দেখা গেছে। ১৯০৯ সালে বন্য হাতি উত্তরের দিকে যাওয়ার পথে বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে হত্যা করে। প্রচুরসংখ্যক স্তন্যপায়ী লেপার্ডকে সর্বত্র দেখা যায়। 

তারপর দেশভাগ। বাঙাল খেদাও এর চাপে লাখে লাখে মানুষ ব্রহ্মপুত্রে ছড়ায়ে গেল। জোতদাররা তাদের দিয়ে জঙ্গল সাফ করে চরের দখল নিল, রেকর্ডে নাম উঠল জোতদারের। আর বানের জলে ভেসে গেছে বাস্তুসংস্থান। নদী মানে অখণ্ড সত্তা, নদী মানে সংলগ্ন বন, প্রত্ন-প্রকৃতির রহস্য। বিবিসির সাম্প্রতিক রিপোর্ট, গাছ না থাকলে মানুষও থাকবে না পৃথিবীতে। চর মানে আজ কয়েকজন জোতদারের হাঁক। 

২. 

প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের ধারণায়, রাষ্ট্রীয়-সামাজিক প্রতিরোধহীনতায় বন সাফ হয়ে যাওয়ায় পৃথিবীর অন্যতম চরপ্রধান নদ ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন আজ ভয়াবহ ভঙ্গিতে। পানিচক্র আর বাস্তুসংস্থান প্রক্রিয়া অধিক বৃষ্টিপাত সৃষ্টি করে পানির উৎসকে পুনঃ সঞ্চালিত করে। নাহলে অন্তত তিনটি বৈরী প্রভাব পানিচক্রে সংগঠিত হয়। ১. বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে বৃষ্টিপাত ও নদীর পুনরুৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করে এবং বছরব্যাপী পানিপ্রবাহ সাময়িক প্রবাহে পরিণত হয়। ২. প্রাকৃতিক গতিপথ থেকে পানির গতিপথ পরিবর্তন, ফলে ভাটি অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের পুনঃ সঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয়, আর্সেনিক সৃষ্টি ও মরুকরণ ত্বরান্বিত হয়। ৩. সমুদ্রে মিঠাপানির প্রবাহ হ্রাস, মিঠাপানি-লোনাপানির ভারসাম্যে বিঘ্ন ঘটে উজানে লবণাক্ততা সংক্রমিত করে ও সামুদ্রিক ক্ষয় ঘটায়। পানিচক্রের প্রতি পরিবেশগত অজ্ঞতা ভূমি ও পানির বাণিজ্যিক ব্যবহারের লাভালাভকে দৃশ্যমান করে তুলেছে। ব্রহ্মপুত্রের জন্যও এই বোঝাপড়া জরুরি। 

কথিত আধুনিক কৃষির সাধারণ সমস্যা হলো মাটির উর্বরতা হ্রাস, ভূমিক্ষয়সহ রোগ ও পোকার আক্রমণ। কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের সক্ষমতার কারণে বনের বেলায় তা ঘটে না। একটি বনে ১ একর জমিতে কমপক্ষে ১০০ জাতের উদ্ভিদ থাকে এবং বাস্তুসংস্থান প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতি মুহূর্তে উর্বর হতে থাকে এবং ক্ষয়ের বদলে উল্টো এলাকা বাড়ায়। যেমন ব্রহ্মপুত্র এলাকায় অবহেলায় বেড়ে উঠত বিন্নার ঝোপ, যার শিকড় ৩-৪ মিটার সোজা মাটির নিচে চলে গিয়ে ভাঙন ঠেকাত, পানিতে মিশে থাকা আর্সেনিক, অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাংগানিজ, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, নিকেল, সিসা, মার্কারি ও জিংক থেকে পানিকে পরিশোধন করত এবং মাটিতে পানি ধরে রেখে মরুকরণ রোধ করত। ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলের বন গড়ে তোলার জন্য শুধু সীমানা নির্ধারণই যথেষ্ট। ব্রহ্মপুত্রের চর থেকে বন উচ্ছেদ করা হলেও তার ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্য আছে। 

নাহিদ হাসান রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি