বস্তির পতঙ্গদের অগ্নিপরীক্ষা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

যখন পুড়ছে না, তখনো বস্তির জীবন এক যুদ্ধ। আর যখন পুড়ছে, তখন তা যেন একাত্তরের ২৫ মার্চে ঢাকার বস্তি পোড়ানো আগুনেই আরেক ছবি। বাংলাদেশিদের প্রাণশক্তির পরিচয় পেতে তাই গুলশান-বনানীতে গিয়ে লাভ নেই, যেতে হবে বস্তিতে বস্তিতে। বড় বস্তি মানে বারবার আগুনে পোড়ার ইতিহাস। এবং বারবার আগুনকে পরাজিত করে আবার জীবনের খুঁটি মাটিতে পোঁতার ইতিহাস।

গুলশানের কড়াইল বস্তিতে বছরে গড়ে অন্তত দুবার আগুন লাগে। ঢাকার মীরপুরে তো বড় বড় বেশ কয়েকটি বস্তি। মেহাম্মদপুরেও হাজার হাজার পরিবারের ঠিকানায় কোনো হোল্ডিং নম্বর নেই, আছে কেবল বস্তির নাম। ভাষানটেক, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, মালিবাগ প্রভৃতি জায়গার বস্তির জীবন মানে আগুনে পুড়ে আবার মাথা তোলার এক জেদি ইতিহাস। বস্তির মানুষের এই প্রাণশক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে কেবল বারবার ভাঙনের কবলে পড়া নদীপাড়ের মানুষেরা। নদী যতবারই ঘর-বাড়ি-কবর খেয়ে নিক, আবারও তারা ঘর তোলে, জীবন গড়ে এবং সেই জীবনের কিনার ঘেঁষে কবরস্থান বানায়। জীবন ও মৃত্যুর এই ম্যানেজারি তাদের করে যেতেই হয়। বস্তির মানুষ আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয় না। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়া গ্রামীণ মানুষেরাই শহরে এসে বস্তিতে সেঁধিয়ে যায়। বন্যার মার কিংবা ফসলের দাম না পাওয়ার তাড়া খেয়ে যারা পালিয়ে মেগা শহরে আসে, আগুনের ভয় হয় তাদের জীবনসঙ্গী। যাওয়ার জায়গা নেই বলে তাদের হার মানারও উপায় নেই।

যে প্রাণবিক জেদে তারা নদীভাঙার বিরুদ্ধে, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করত, তাদের গোষ্ঠী স্মৃতিতে, সামাজিক ডিএনএতে, সহজাত প্রবৃত্তিতে সেই জেদের বীজ মজুত থেকে যায়। নয়তো কীভাবে প্রতিবার পুড়ে যাওয়ার পর, হেরে যাওয়ার পরও পালায় না। নতুন করে ঘর তোলার আগেই তাদের দাঁড়াতে হয় নগর প্রশাসন, গডফাদার ও ‘উন্নয়ন জমিদার’দের খেদাও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে। এসব করে করে বস্তির পোড়ামাটিতে আবার তারা ঘর বাঁধার খুঁটি পোঁতে, চালু করে মানবিক রান্নাবান্না! মাটি কামড়েই তারা বাঁচে। হ্যাঁ, মহানগরে মাটির দেখা মূলত বস্তিতে গেলেই পাওয়া যায়।

হয়তো খেয়াল করা হয় না, সারা বছরই ঘুরে-ফিরে বিভিন্ন বস্তিতে আগুন লাগার খবর আসে। এই আগুনের জন্য উপযুক্ত বিশেষণ হলো ‘লাগাতার’ ও ‘পালাক্রমে’। এভাবে লাগাতার ও পালাক্রমে আগুন লাগার কিংবা লাগাবার রহস্যভেদ করার কোনো কর্তৃপক্ষ খুঁজে পাওয়া যায় না। বস্তি পোড়ার দায় কেউ নেয় না, হাবিজাবি কার্যকারণ তুলে ধরে দায় সারে দমকল বিভাগ। নগর প্রশাসনের ‘পিতারা’ অন্য সময় বস্তি নিয়ে বিরক্ত থাকেন, আগুনের সময় থাকেন অতিমাত্রায় নীরব। আমরা কেবল জানতে পারি এই সরকারি বয়ান, ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’। কী সুন্দর ঘোষণা, ‘কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কিছু জানে না’।

বস্তি নামের মধ্যেই তুচ্ছ করা আছে, অবজ্ঞা আছে। বস্তি মানে বসতি—যেখানে সমাজ আছে, গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন আছে। অথচ বসতি নামে আলিশান অ্যাপার্টমেন্ট ভবন হয়, যেখানে কেউ কাউকে না চেনার উদাসীন জীবনের ‘আরামের’ নাম নাগরিকতা আর যারা সেসব ভবনের যাবতীয় সেবাকাজ মধ্যযুগীয় কায়দায় করে, মহানগরের পদাতিকের যুদ্ধটা চালায়, ময়লা পরিষ্কার করে, গাড়িঘোড়া-দপ্তরকে সচল রাখে, সেসব গরিবের বসতির নাম হয় বস্তি। ওই যে কে যেন বলেছিল না, ‘আমি খাই, তুই গিলস; বড়লাটে করেন আহার আর মহারানি ভিক্টোরিয়া করেন ভোজন।’ তেমনি মানববসতিকে মানবেতর জায়গায় নিয়ে গেলে তার নাম হয় ‘বস্তি’। বস্তিবাসীর প্রতি বসতিঅলাদের মধ্যে যে চাপা ঘৃণা ও অবজ্ঞা দেখা যায়, তা ওই মধ্যযুগীয় আরামভোগের জন্য দারুণ দরকারি।

বস্তি নোংরা, বস্তিবাসী অলস, তারা পঙ্গপালের মতো চলে, ক্রিমিনাল হয়, নেশা করে বা ইয়াবা বেচে—এসব কথা প্রবাদবাক্যের মতো মর্যাদা পায় মধ্যবিত্তের মজমা আর উঁচুতলার আসরে। অথচ বস্তির দারিদ্র্য যাঁরা সৃষ্টি করেন, মাদক ব্যবসাসহ বিবিধ অপরাধকর্মে তাদের যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁরা কিন্তু বস্তির লোক না। তাঁরা থাকেন তথাকথিত ‘সভ্য সুন্দর নিরপরাধ’ ভিআইপি এলাকায়। বস্তির অন্ধকার দিকের জন্ম ওই সব আলোকিত এলাকায়। বস্তির আগুনের সলতেটাও ওই সব ভিআইপি তথা নব্য জমিদারদের হাতেই ধরা। অন্য নামে তাঁদের কাউকে কাউকে জনপ্রতিনিধি-সাংসদ হিসেবে চিনি।

এই জমিদারেরাই সরকারি জায়গায় বস্তি বসিয়ে ভাড়া তুলে আরও ধনবান হন। বস্তির লোককে জিম্মি করে রাজনৈতিক প্রতাপ দেখান। এইসব বস্তির প্রতি বর্গফুট জায়গার ভাড়া যেকোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুট ভাড়ার চেয়ে বেশি। মৌলিক অধিকারের মুখে ছাই মেখে সরকারি সংস্থার বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি তাদের কিনতে হয় বাজারমূল্যের চাইতে বেশি হারে—যেহেতু সেসব তাদের অবৈধ পথে পেতে হয়। বস্তিনির্ভর অর্থনীতির শেষ দৃশ্যে আসে আগুন। হানাদারদের পোড়ামাটি নীতি বাস্তবায়নের অবাধ ক্ষেত্রও এই বস্তি। আগুন দিয়ে মানুষগুলোকে তাড়িয়ে সেই পোড়া মাটিতে বহুতল ভবন নির্মাণের পাঁয়তারা চলে। আমরা কেবল আগুনটা দেখি, আগুন ধরার আগের ও পরের এই তেলেসমাতিটা সবার চোখে পড়ে না।

এই আগুন-থেরাপি খুব কাজের। পুলিশ-মাস্তান দিয়ে জোরজুলুম করে বস্তি উচ্ছেদের চেয়ে অনেক স্মার্ট আগুনের এই থেরাপি। এতে কেউ মরলে বা হতাহত হলে দায় নিতে হয় না। পুলিশ-প্রশাসন ও এমপিদের সমালোচনা শুনতে হয় না। ভুক্তভোগীরাও ‘আল্লাহর কাছে’ ছাড়া ফরিয়াদ জানানোর আর কাউকে পায় না। আগে বস্তি-নিপীড়ন হলে নাগরিক সমাজে শোরগোল হতো, এখনকার দশা হলো ‘চাচা আপনা প্রাণ বাঁচা’।

একজন মন্ত্রী বলেছেন, উন্নয়নের সময় ডেঙ্গু হয়ে থাকে। উন্নয়নের সময়ে ঘন ঘন বস্তিও পুড়ে থাকে। উন্নয়নের সোনালি গল্পে যে স্বর্ণালি আভা দেখা যায়, তার উৎস দূরের ওই সব বস্তির আগুন। সেই আগুনে যাদের জীবন পোড়ে, তারা হয়তো মানুষ নয়, তারা উন্নয়নের পতঙ্গ। কিন্তু সেই আগুনে যারা আলু পুড়িয়ে খায়, তারা কারা?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]