চামড়া-চক্রান্ত চাট্টিখানি ব্যাপার নয়

বাজারে ক্রেতাসমাগম কম থাকায় চামড়ার দাম কম। হতাশ ব্যবসায়ীরা। শম্ভুগঞ্জ চামড়া বাজার, ময়মনসিংহ, ১৮ আগস্ট
বাজারে ক্রেতাসমাগম কম থাকায় চামড়ার দাম কম। হতাশ ব্যবসায়ীরা। শম্ভুগঞ্জ চামড়া বাজার, ময়মনসিংহ, ১৮ আগস্ট

অতি আপনজনের মৃত্যুতে ছাড়া কোনো বয়স্ক মানুষ যখন ডুকরে কেঁদে ওঠেন, তখন বুঝতে হবে তাঁর মনের দুঃখ প্রিয়জন বিয়োগের চেয়ে বিশেষ কম নয়। ঈদের দিন এবং ঈদের পরদিন আমি কিছু মানুষকে প্রকাশ্যে কাঁদতে দেখেছি।

ব্যবসা-বাণিজ্য ও কায়কারবারে লাভ-ক্ষতি দুই-ই থাকে। লাভের মতো ব্যবসায় ক্ষতি হওয়াও খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক ব্যবসায়ীর পুরো কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তা ব্যক্তিবিশেষের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু কোনো দেশের কোনো বিশেষ শ্রেণির সব ব্যবসায়ীর একসঙ্গে পুঁজিপাট্টা হারিয়ে পথে বসার ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। তা শুধু বাংলাদেশেই হতে পারে। এখানে শেয়ারবাজারে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ধস নামায় কেউ ফতুর হয়ে কেঁদে বুক ভাসান, কেউ করেন আত্মহত্যা।

কৃষক ধানের দাম না পেয়ে মনের দুঃখে সড়কে ধান ফেলে দেন। এবার মৌসুমি চামড়ার ছোট ব্যবসায়ীরা সব পুঁজিপাট্টা হারিয়ে হাহাকার করছেন। কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা কোরবানির চামড়া কেউ খালে, কেউ নর্দমায় বা নদীতে ফেলে দিয়েছেন, কেউ মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। একজন কারবারি তাঁর পণ্য কোন পরিস্থিতিতে মাটিতে পুঁতে দেন বা নর্দমায় ফেলে দেন, তা নির্বোধও বোঝে।

মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলায় গবাদিপশুসম্পদ ও চামড়াশিল্পের অপার সম্ভাবনার কথা এক শ বছর আগে একজন ইউরোপীয় ইহুদি ভেবেছিলেন। তিনি নিজে চামড়া ব্যবসায়ী ছিলেন না, ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ এবং পূর্ব বাংলার মানুষের হিতার্থী। তিনি স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। একজন রসায়নবিজ্ঞানী। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কয়েকজন রসায়নবিজ্ঞানী ছিলেন তাঁর বন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগকে তিনি বিশ্বমানের করতে চেয়েছিলেন, যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েও একদিন নোবেল পুরস্কার আসে। প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলার, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিএসসি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল তরুণ শিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষকে তিনি সবচেয়ে বেশি বেতন দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন রসায়ন বিভাগকে সমৃদ্ধ করতে। আরও কয়েকজন পণ্ডিতকে সারা ভারত থেকে খুঁজে আনেন।

অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর পূর্ব বাংলায় বেকারত্ব দূর করতে ১৯২২ সালে সরকার গঠন করে, ‘ঢাকা টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন কমিটি’—ঢাকা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কমিটি। স্যার ফিলিপ হার্টগ ছিলেন এর সভাপতি। আজ ফার্মগেট নামে তেজগাঁওয়ের শেরেবাংলা নগরে যে জায়গাটি দেখি, সেখানে কৃষি গবেষণার সূচনা ঘটান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হার্টগ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অ্যাগ্রিকালচার ইনস্টিটিউট। ১৯২৪ সালে তিনি বাংলার গভর্নর লর্ড লিটনকে লিখেছিলেন: আই সিনসিয়ারলি হোপ দ্যাট দ্য রিকমেনডেশনস অব দ্য কমিটি, মে বি অ্যাডোপটেড, টু দ্য বেনিফিট অব দ্য ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড দ্য পাবলিক অব ইস্টার্ন বেঙ্গল [স্যার ফিলিপ হার্টগ, প্রথমা প্রকাশন, পৃ. ৭৫-৭৬]। পূর্ব বাংলার মানুষের কল্যাণে তিনি সুপারিশ করলেও সরকার ‘ন্যাসেসারি ফান্ডস’ দিতে পারেনি। তবে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বাবা এবং হার্টগের ছাত্র আশুতোষ সেনকে ১৯২৪ সালে বিহারের পুসায় ইম্পিরিয়াল কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে একটি বৃত্তি জোগাড় করে পাঠিয়েছিলেন কৃষি গবেষণায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে।

১৯২৪ সালে চামড়া রসায়ন নিয়ে গবেষণা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ট্যানিং অ্যান্ড লেদার কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট’ খোলার সুপারিশ করে সরকারের কাছে অর্থ বরাদ্দ চান হার্টগ। পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে চামড়াশিল্প বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে, সে কথা সরকারকে লিখে জানান। ১৯২৫ সালের সমাবর্তনের অভিবাসনে হার্টগ বলেছিলেন, ‘চামড়া বিভাগের অধীনে একটি “লেদার প্ল্যান্ট” প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা এবং কিছু অর্থ আমার আছে—দ্য ক্যাপিটাল ন্যাসেসারি ফর দ্য ইরেকশন অব দ্য ন্যাসেসারি প্ল্যান্ট।’ ১৯২৬ সালে হার্টগ ইন্ডিয়ান পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চলে যাওয়ার পর তাঁর পরবর্তী উপাচার্য জি এইচ ল্যাংলিও চামড়া প্রকল্প এগিয়ে নিতে তাঁর মতো চেষ্টা করেন। তাঁরা চেয়েছিলেন সমগ্র বাংলায় ঢাকা হবে চামড়াশিল্পের প্রধান কেন্দ্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হয়েও উঠেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও চামড়া ছিল রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম পণ্য।

 এ দেশের চামড়া ব্যবসা নিয়ে যা হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের একজন বন্ধু হিসেবে তাতে হার্টগের আত্মা কষ্ট পেয়ে থাকবে। দুনিয়াতে অনেক মানুষই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল দেয়, কিন্তু পৃথিবীতে খুব কম জাতই তার নিজের পায়ে কুড়াল হানে। পূর্ব বাংলার পরম সম্পদ পাট রপ্তানির টাকা কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এ কথা বলতে বলতে আমরা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে স্বাধিকার আন্দোলন করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে পাটচাষিদের না খাইয়ে মারছি, বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল আদমজীকে হত্যা করেছি। পাট থেকে রপ্তানি আয় ক্রমাগত কমছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাট খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ১০২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার, ২০১৮-১৯-এ অর্জন মাত্র ৮১ কোটি ৬২ লাখ ডলার, লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৮ কোটি ডলার (সূত্র: রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো)।

অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, যেখানে চামড়া থেকে রপ্তানি আয় ক্রমাগত বাড়ার কথা, সেখানে কমছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া রপ্তানি করে আয় হয় ৩৯ দশমিক ৮ কোটি ডলার। বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৫ কোটি ডলার। এ বছর থেকে কত হবে, তা বিধাতা বলতে পারেন। আরও পরিহাসের বিষয়, যেখানে দর না পেয়ে দেশের মানুষ চামড়া ফেলে দিচ্ছে, সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ট্যানারির মালিকেরা আমদানি করেছেন প্রায় ৯৪৫ কোটি টাকার বিদেশি চামড়া। 

ট্যানারির মালিক ও চামড়ার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে আজকের এই বিপর্যয়। খুলনার ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ঢাকার ট্যানারির মালিকদের কাছে তাঁদের পাওনা ৫০-৬০ কোটি টাকা। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি বলেছেন, ট্যানারির মালিকদের কাছে তাঁদের পাওনা ৫০ কোটি টাকা। তাঁর মতে, চামড়া নষ্ট হওয়ার জন্য মূলত দায়ী ট্যানারির মালিকেরা। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের কাছে যে পুঁজি ছিল, তার পুরোটাই ট্যানারির মালিকদের কাছে আটকা পড়ে আছে। এখন মূলধন নেই। আড়তদারেরা যেহেতু এবার খুব একটা চামড়া কেনেননি, তাই বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে’ [প্রথম আলো]।

প্রচলিত প্রথা, প্রতিবছর কোরবানির ঈদে ট্যানারির মালিকেরা আড়তের মালিকদের পুরোনো বকেয়া শোধ করেন, যা দিয়ে চামড়া কিনে আবার ট্যানারির মালিকদের দেন আড়তদারেরা। তাঁরা অবশ্য আড়তদারদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন। আড়তদারেরা বলছেন, তাঁরা নন, ট্যানারির মালিকেরা দায়ী। তাঁদের ভাষায়, ‘আমাদের টাকায় তাঁরা হলেন হিরো। আমরা হলাম জিরো। আমাদের টাকা নিয়ে গাড়ি-বাড়ি করছেন। তাঁরা আমাদের সঙ্গে যে খেলা খেলছেন, তার অবসান হওয়া দরকার।’

এই রকম একটা গুরুতর পরিস্থিতিতে ঈদের ছয় দিন পরে ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে টানা আড়াই ঘণ্টা’ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে সভা হয়। সেখানে ‘হট্টগোল’ হয়েছে, সেটাও স্বাভাবিক। একদা শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী সাফ বলে দিয়েছিলেন, ‘বাংলা ভাই’ মিডিয়ার সৃষ্টি। চামড়া–চক্রান্তে দোষ মিডিয়ার। চামড়া নষ্ট করা প্রসঙ্গে বর্তমান শিল্পমন্ত্রী বললেন, ‘তাহলে বিএনপি (চামড়া) কিনে ফেলে দিয়েছে।’ বিএনপিকে দুই চোখে দেখতে পারে না, এমন মানুষও এই বক্তব্যে লজ্জিত। কেউ কেউ শুধু বলেছেন, ‘ছি’। আমি গত ৫০ বছরে উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত মাননীয় মানুষদের যে পাঁচটি দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি শুনেছি, এটি তার অন্যতম।

চামড়া নিয়ে যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা কোনো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। জাতীয় অর্থনীতির বিরুদ্ধে সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত। এর পেছনে কারা, তা তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে হতভাগ্য জনগণের ধারণা হবে, এর জন্য শুধু যে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা দায়ী তা নয়, দুই মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের কেউ কেউ প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন। 


সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক