ইয়েমেন কি বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে?

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

এডেন শহর দখলে ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাফল্য দেশটির জরাজীর্ণ ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে বলেই মনে হচ্ছে। এটা প্রেসিডেন্ট আবদ-রাব্বু মনসুর হাদির সরকারের বৈধ কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের সব ধরনের চেষ্টাকে কার্যকরভাবে দুর্বল তো করেছেই, এর পাশাপাশি দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে বিপন্ন করে তুলেছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ইয়েমেন থেকে তার বেশির ভাগ সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলে প্রেসিডেন্ট হাদির বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ ইয়েমেনে, বিশেষ করে এডেন শহরে এবং এর সমুদ্রবন্দরে যা ঘটেছে, তা আমিরাতি পরিকল্পনার একটা অংশ।

আসলে ইয়েমেনকে ভেঙে দুটি দেশ করার পরিকল্পনা করছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারা বর্তমান ইয়েমেনকে ভেঙে নব্বইয়ের দশকের আগের অবস্থায় অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেনে বিভক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশ দুটির একটি অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই ইউএইর প্রধান উদ্দেশ্য।

 আমিরাতি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা অবশ্য ইয়েমেনের অস্থিতিশীলতা যে আরব উপদ্বীপ এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের (জিসিসি) সম্মিলিত সুরক্ষার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে, সে বিষয়টি মাথায় রেখেছেন। এ জন্য তাঁরা সব সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেননি। তার ওপর হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনি বন্দরগুলোতে (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে এডেন) তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে, যা কিনা আরব উপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এটাও তাঁদের মাথায় রয়েছে। এ কারণেও তঁারা সব সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত বাণিজ্যিক বন্দর পরিচালনা এবং সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে সফল হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এ ছাড়া জেবুতি, সোমালিল্যান্ড ও ইরিত্রিয়ায় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে অপারেশন ডিসিসিভ স্টর্ম শুরু হওয়ার পর থেকে ইয়েমেনে আমিরাতি কৌশলের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা হয়েছে। তবে হুতি বিদ্রোহীদের থামানো এবং জিসিসির সম্মিলিত সুরক্ষা বজায় রাখার জন্য ইউএইর প্রচেষ্টার অর্থ এই না যে সেখানে প্রেসিডেন্ট হাদির বৈধ কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। বরং ইয়েমেনকে বিভক্ত করাই তাদের উদ্দেশ্য। তবে এটাও সত্যি যে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট কখনোই বিশ্বাস করেননি যে সংযুক্ত আরব আমিরাত তার বৈধ শাসন পুনরুদ্ধার করতে কাজ করছে।

প্রকৃতপক্ষে ইয়েমেনে ২০১৫ সালের মার্চ মাসে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইয়েমেনের সম্পর্কটা বিভ্রান্তিকর। একদিকে ইউএই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট হাদি সরকারকে সমর্থন করছে, অন্যদিকে দক্ষিণে তার বিরোধীদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছে এবং মূল ভূখণ্ড থেকে দক্ষিণাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার পথ প্রশস্ত করছে।

আমিরাতি বাহিনী এবং তাদের ইয়েমেনীয় মিত্ররা উত্তরে মোকা এবং হোদেইদার উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই দুটি এলাকাতেই কৌশলগত সামুদ্রিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়া তারা হুতি বিদ্রোহীদের অস্ত্র আমদানির ক্ষমতা সীমিত করতে ইয়েমেনের পশ্চিম উপকূলে অবরোধ আরোপ করেছে।

২০১৮ সালের শেষ দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত সর্বশেষ ইয়েমেনে যখন সামরিক অভিযান চালায়, তখন তারা হোদেইদার আশপাশে হুতিদের বিরুদ্ধে ইয়েমেনি সেনাদের সমর্থন দিয়েছে। এ ঘটনার পর ইয়েমেনের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ দূত মার্টিন গ্রিফিথস হোদেইদার আশপাশে যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে স্টকহোমে আলোচনা শুরু করেন, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। আগস্টের শুরুতে এডেনে যা ঘটেছে, সে সম্পর্কে সৌদি আরবের অবস্থান অস্পষ্ট। তবে সৌদি আরবের বর্তমান অবস্থান যা-ই হোক না কেন, রিয়াদ ইয়েমেনে অপারেশন ডিসিসিভ স্টর্ম চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট হাদিকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা পালনে অক্ষম বলেই মনে হচ্ছে। ইয়েমেনে এখনো শান্তি ফিরে আসেনি, সৌদি নেতৃত্বাধীন হামলার কারণে সেখানে প্রতিদিন মানুষ মরছে। দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। আর এ জন্য রিয়াদকে তীব্র আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু এ রকমটা হওয়া উচিত ছিল না। ইয়েমেনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ব্যাপক সম্পর্ক থাকার কারণে সৌদি আরব বহুদলীয় সংলাপে একটি নতুন ইয়েমেনের জন্য সমঝোতায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করতে পারত, যেখানে সব দল ভূমিকা রাখতে পারবে।

হুতি বিদ্রোহীরা এখনো সানা এবং অন্যান্য অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে আছে এবং তারা ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন দিয়ে সৌদি আরবের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এখন ইউএই যা করছে তা স্পষ্টত ইয়েমেনকে বিভক্ত করার চেষ্টা। তাদের এ চেষ্টা সফল হতে দেওয়া উচিত হবে না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, আল-জাজিরা থেকে নেওয়া

ইমাদ কে হার্ব : ওয়াশিংটন ডিসির আরব সেন্টারের গবেষক ও বিশ্লেষক