চামড়াশিল্পের বিপন্নতা

আমাদের চামড়াশিল্পের সম্ভাবনা এমন উজ্জ্বল যে ভাবা হয়েছিল, রপ্তানির ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের পরেই চামড়াজাত পণ্যের স্থান হবে। বিশেষত জুতা তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মান ও স্বীকৃতি অর্জন করেছে। তারা ইউরোপ–আমেরিকার বিভিন্ন দেশে জুতা রপ্তানি করছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি জুতার কদর বাড়ছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্সা) হিসাব দিয়েছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়েছিল ৬ কোটি ১৪ লাখ ডলারের জুতা। চার বছরের মাথায় ২০১৮ সালে রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি; ওই বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ কোটি ৩২ লাখ মার্কিন ডলারের জুতা রপ্তানি করেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতেও বাংলাদেশের জুতা রপ্তানি বাড়ছে। কিন্তু চামড়াশিল্পের মোট রপ্তানি আয় ক্রমবর্ধমান হারে কমে যাচ্ছে। এশিয়া ফাউন্ডেশন ও পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট যৌথভাবে সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে পেয়েছে, ২০১৬–১৭ অর্থবছরে চামড়া খাতের মোট রপ্তানি আয় ছিল ১২৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। পরের অর্থবছরে তা কমে ১০৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারে নেমেছে এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে মাত্র ৭৭ কোটি ডলার।

এটা উদ্বেগের বিষয়। রপ্তানি কমার এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের চামড়াশিল্প বিকাশের সম্ভাবনাও কমে যাবে। কারণ, রপ্তানিমুখিতার কারণেই আমরা এর বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা লক্ষ করেছি। সুতরাং রপ্তানি কমার এই ধারা বন্ধ করে বরং তা বাড়ানোর দিকেই আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। এবং সেটা করতে গেলে প্রথমেই দেখতে হবে রপ্তানি কমার কারণ কী। প্রধান কারণটি ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে এবং তা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। সেটা হলো চামড়াশিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়নি বলে বিশ্ববাজারে আমাদের চামড়াজাত পণ্যের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমরা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ নামের এক বৈশ্বিক সংস্থার মানসনদ অর্জন করতে পারিনি। কোনো দেশের এই সনদ না থাকলে চামড়াজাত পণ্যের আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সেই দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে উৎসাহ দেখায় না। আমাদের চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ সেটাই।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কেন চামড়াশিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের মানসনদ অর্জন করতে পারিনি। সরকার কী করছে। সাভারে চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০০৩ সালে। মোট প্রকল্প ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি (৬৪২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা) অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইপিটি) নির্মাণের জন্য। ২০১২ সালে সেটি নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে চীনা এক কোম্পানিকে; শর্ত ছিল কাজ শেষ করতে হবে দেড় বছরের মধ্যে। কিন্তু পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ সাত বছর, তবু নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। আর সিইপিটি নেই বলে বিদেশি ক্রেতারা আমাদের চামড়াজাত পণ্য আমদানিতে উৎসাহিত হচ্ছে না। তাইওয়ানের একটি কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের বে গ্রুপ নামের একটি কোম্পানি যৌথ বিনিয়োগে ট্যানারি প্রতিষ্ঠা করতে এসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে সিইপিটি নেই বলে।

এখন যা করা প্রয়োজন তা হলো শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিইপিটি ও ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজ শেষ করতে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির মুখোমুখি করা। জবাবদিহি নেই বলেই বছরের পর বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের চামড়াশিল্প স্বাভাবিক অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারছে না এবং সেই কারণে আন্তর্জাতিক মানসনদ অর্জন করতে পারছে না। অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন করে চামড়াশিল্পের বিকাশ এগিয়ে চলেছে। এভাবে কালক্ষেপণ আর চলতে দেওয়া যায় না। অতি দ্রুত সিইটিপি চালু করে চামড়াশিল্পের বিকাশের পথের প্রধান প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হোক।