শিশুদের জন্য বিশ্বের অনেক কিছু করার আছে

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ফাতেমা (ছদ্মনাম) শিক্ষক হতে চায়। কারণ, সে মনে করে শিক্ষিত হলে সে অন্য শিশু, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষিত হতে সাহায্য করতে পারবে। ফাতেমার বয়স এখন ১৩। মা–বাবা, দুই বোন ও পিতামহের সঙ্গে সে এখন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে বসবাস করছে। দুই বছর আগে প্রাণভয়ে একদম শূন্য হাতে সে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। সে সময় সে এমন সব কঠিন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে, যা তার বয়সী কোনো শিশুরই হওয়ার কথা নয়। আজ থেকে দুই বছর আগে, ২০১৭ সালের আগস্টে, প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শিশুকে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যার পরে পৃথিবীতে এটাই সবচেয়ে বড় গণবাস্তুচ্যুতি।

রোহিঙ্গা শিশুরা যে ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে, তা আমাদের জানিয়েছে। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকেই নিজে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অনেকে নিজের চোখে নির্যাতনে তাদের পরিবার-পরিজনদের মৃত্যু দেখেছে। তাদের ঘরবাড়ি যখন পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছিল, তখন পালিয়ে বাঁচা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা নিরাপদ ছিল না। নির্যাতিতদের খুব অল্পসংখ্যকই নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছাতে পেরেছে। আর সংহতির এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের জনগণ আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণকে সাহায্য করতে পুরো বিশ্ব তখন একজোট হয়ে এগিয়ে আসে; শিশু শরণার্থী ও তাদের তত্ত্বাবধানকারীদের থাকার জায়গা ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণে পণ্য ও পরিষেবা নিশ্চিত করতে ব্যক্তি, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, এনজিও, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ও জাতিসংঘ একযোগে কাজ শুরু করে।

সংহতির ফলস্বরূপ, জোরপূর্বক নির্বাসনের এই ট্র্যাজেডি মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হতে পারেনি। কক্সবাজার জেলার ঘন বনজঙ্গলের একটা বিরাট অংশ পরিষ্কার করা হয়, অস্থায়ী ঘর বানানো হয়, শিশুদের জন্য খাবার পৌঁছে দেওয়া হয় এবং রোগবালাই যাতে মহামারিতে রূপ নিতে না পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে স্বাস্থ্যবিষয়ক বড় ধরনের জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করা সম্ভব হলেও এখনো অধিকাংশ শরণার্থী সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে।

সেভ দ্য চিলড্রেন ২০১২ সাল থেকে কক্সবাজারে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শরণার্থী শিশু ও স্থানীয় বাংলাদেশি শিশু উভয়কেই স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি এবং সম্ভবত সবকিছুর ওপরে শিশু সুরক্ষামূলক সেবা দিয়ে আসছে। আমরা আমাদের জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এখন পর্যন্ত চার লাখের বেশি শিশুকে সেবা দিয়েছি। কিন্তু ফাতেমার মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের এ রকম জীবন অপ্রত্যাশিত। শিক্ষা গ্রহণের অদমনীয় আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার দুয়ার তার জন্য খোলা নেই। শরণার্থীশিবিরগুলোতে শিশুদের জন্য কেবল প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ দিয়ে আমরা আসলে তাদের ব্যর্থই করছি, কারণ ভবিষ্যতে তারা নিজ জনগোষ্ঠী কিংবা বৃহৎ অর্থে পৃথিবীর জন্য কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। ফাতেমার শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নকে আমরা ছিনতাই করছি, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

শিশুরা যেসব ঘরে থাকছে, সেগুলো অস্থায়ীভাবে বাঁশ এবং পলিথিন দিয়ে তৈরি। ঘূর্ণিঝড়ের কথা বাদই দিলাম, একটা শক্ত ঝড়েও টিকে থাকতে পারবে না এই ঘরগুলো। শিবিরের প্রতি দশজনের একজন শিশু এখনো অপুষ্টিতে ভুগছে। শিবিরগুলোতে নিরাপত্তাব্যবস্থা সে অর্থে মজবুত নয়। পাচার, মাদকের বেচাকেনা ও ব্যবহার এবং সহিংস অপরাধপ্রবণতা শিশুদের জন্য অনিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকায় সন্ধ্যার পর পানি আনা কিংবা ল্যাট্রিনে যাওয়ার মতো সাধারণ কাজগুলোও শিশুদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিও গ্রহণযোগ্য নয়।

কিন্তু বিষয়টা এতটা সাদামাটাও নয়। রোহিঙ্গা শিশুদের পাশাপাশি দুই বছর আগে যে স্থানীয় জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানিয়েছিল, তাদের শিশুদের জীবনও উল্টেপাল্টে গেছে। গ্রাম ও ছোট মফস্বল শহরগুলোকে হঠাৎ করে লাখ দশেক মানুষের আগমন মোকাবিলা করতে হয়েছে। বনায়ন ধ্বংসের কারণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর আশপাশের স্থানীয় বাড়ি ও গ্রামগুলো সবচেয়ে বেশি বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকিতে পড়েছে। দুই বছর আগে এ অঞ্চলে যে স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, সেগুলো এখন ভারাক্রান্ত। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শিশুদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।

তবু দুই বছরে আমরা কোনো সমাধানের আলো দেখছি না। শরণার্থীশিবিরে বসবাসরত প্রায় ৬ লাখ শিশুর এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। মিয়ানমারে নিরাপদ, স্বেচ্ছাসেবী ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা দূরাতীত। অন্য কোনো তৃতীয় দেশও পুনর্বাসনের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসছে না। এমনকি বাংলাদেশের ভেতরেও কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ও স্থায়ী স্থানান্তরের আশা দেখা যাচ্ছে না।

একটা কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে যে রোহিঙ্গা শিশুরা একটি হারিয়ে যাওয়া প্রজন্মে পরিণত হবে। কিন্তু তারা আসলে হারিয়ে যায়নি। পৃথিবী জানে রোহিঙ্গা শিশুরা কোথায় আছে। তাদের শিক্ষা, নিরাপত্তা এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সবার সহায়তা দরকার। এই শিশুদের ভুলে যাওয়া আমাদের ঠিক হবে না।

রোহিঙ্গা শিশুদের সামনে অবশ্যই আশার আলো থাকতে হবে যে তারাও একদিন তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম হবে। দুই বছর ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণ বিশ্বমহলে দারুণ নজির স্থাপন করেছে। আর তাই বিশ্ববাসীর কাছ থেকে তাদের অবিরত সহায়তা প্রয়োজন।

কিন্তু এই অবস্থার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান রয়েছে মিয়ানমারের হাতে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের পক্ষে শর্ত তৈরি করা দরকার। প্রথমত, যারা রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করেছে, সেই অপরাধীদের জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে এই শর্তগুলো বিদ্যমান থাকে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার সরকারকে রাখাইনে চলমান দ্বন্দ্ব বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, শিশু অধিকার সম্পর্কিত জাতিসংঘের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী রোহিঙ্গা শিশুদের একটি পরিষ্কার ও স্পষ্ট জাতীয়তা থাকবে হবে।

হোক রোহিঙ্গা কিংবা বাংলাদেশি, কক্সবাজারের সব শিশুর জীবনই এই সংকটে আক্রান্ত হয়েছে। ফাতেমার জন্য একটা সুন্দর জীবন, সে যাতে তার স্বপ্নকে লালন করতে পারে, সে সুযোগ এবং যে দ্বন্দ্বের সঙ্গে সে কোনোভাবেই জড়িত নয়, সেটার বলি যেন সে না হয়, তার নিশ্চয়তা দিতে আমরা বাধ্য।

বিশ্বের এখনো অনেক কিছু করার রয়েছে।

ডেভিড স্কিনার :সেভ দ্য চিলড্রেন–এর রোহিঙ্গা রেসপন্সের টিম লিডার