ইংরেজি না জানা কাজের কথা নয়

‘বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’—প্রায় শতবর্ষ আগে কবি কাজী নজরুল ইসলাম কীভাবে বুঝেছিলেন এ যুগে মুঠোফোন আসবে? হয়তো এ পঙ্‌ক্তির তাৎপর্য ভিন্ন, কিন্তু আক্ষরিক অর্থে এ যেন মুঠোফোনেরই ভবিষ্যদ্বাণী। শুধু মুঠোর মধ্যেই এখন পৃথিবী সীমাবদ্ধ নয়, মানুষ নিজেকেও ছড়িয়ে দিতে চাইছে পুরো বিশ্বে। যোগাযোগব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্যে ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে’র অভিযাত্রিকেরা তাদের ঈপ্সিত দেশ, প্রকৃতি, মানুষ, পুরাকীর্তি, উদ্ভাবন দেখে আসছে। দেখার ইচ্ছা যাদের প্রবল, জানার স্পৃহাও তাদের অফুরান। কিন্তু জানতে ও জানাতের মধ্যে যে মাধ্যম, তা ভাষা। বলা বাহুল্য, ইংরেজি ভাষাই এর প্রধানতম মাধ্যম। এখনো ইংরেজিই আন্তর্জাতিক ভাষার পয়লা নম্বরে।

পর্যটনশিল্প এখন বিশ্বে অন্যতম প্রধান ব্যবসা। যেসব দেশে প্রকৃতি ও স্থাপনায় আছে বিশেষত্ব, ঐতিহাসিক উপাদান, বৈচিত্র্য, সেসব দেশে পর্যটক বেশি। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা পর্যটনে রমরমা। আমাদের রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত, প্রাচীন স্থাপনা, নানা বর্ণের মানুষ, সংগ্রাম ও সংস্কৃতির ইতিহাস। পর্যটকদের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে প্রদর্শক, যিনি কিনা সঠিক তথ্যসহ ভালো ইংরেজিতে ধারণা প্রদানে সক্ষম। আজ থেকে দুই দশক আগের ভারত ভ্রমণ এবং ইদানীংকার ভ্রমণে অনেক পার্থক্য লক্ষ করা গেল। প্রচলিত গতানুগতিক প্রদর্শকের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল তরুণ-তরুণীদেরও দেখা গেল। তাঁরা দেশ ও জাতিভেদে পর্যটকদের আলাদা আলাদা দল তৈরি করে কেউ ইংরেজি, কেউ ফরাসি, কেউ স্প্যানিশ ভাষায় দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে চমৎকার করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে তাঁরা পেশাদারত্বও অর্জন করেছেন বলে মনে হলো। পর্যটকেরা তাঁদের বর্ণনা শুনে মাঝেমধ্যেই হো হো করে হেসে উঠছেন। বোঝা গেল, তাঁদের বর্ণনা কেবল গাদ্যিক বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ নয়, তাকে আকর্ষণীয় করার শিল্পও তাঁরা রপ্ত করেছেন। সাধারণ প্রদর্শকের তুলনায় তাঁরা আয়ও করছেন অনেক বেশি। পর্যটনশিল্পকে দেশের মূল উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য যেমন দরকার হয় দক্ষতার, তেমনি গোড়ায় থাকতে হয় দেশপ্রেম। ভারতীয়রা সেটা বুঝে ফেলেছে।

মাতৃভাষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে যে যত বিদেশি ভাষা শিখবে, তার ভবিষ্যৎ তত উজ্জ্বল। কারণ, পৃথিবীটা এখন গ্লোবাল ভিলেজ। যার সামর্থ্য আছে, সে বেশি ভাষা শিখবে, নিদেনপক্ষে ইংরেজি। ইংরেজির পাশাপাশি সমানভাবে যদি তারা মাতৃভাষাটিও ধরে রাখে, তাহলে দ্বিভাষিক হিসেবে ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্র তাদের জন্য আরও প্রসারিত হবে। ত্রিভাষিক, বহুভাষিক হলে তো কথাই নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েক বছর আগে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে পাস করা চীনা মেয়েটি একই সঙ্গে বাংলা ভাষা শিখে এখন তিন ভাষাতেই একেবারে চৌকস। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে একটি চীনা কোম্পানিতে অনেক উচ্চ বেতনে চাকরি করছেন। তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগকৃত চীনা ব্যবসায়ীদের টানাটানি।

অথচ প্রায় দুই যুগ পর থাইল্যান্ডে বেড়াতে গিয়ে সেই একই হতাশার সম্মুখীন হলাম। বেড়াতে গিয়ে তো কেনাকাটাও হয়। ভারতীয় অভিবাসী দোকানদারেরা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন ইংরেজি-হিন্দিতে। কিন্তু থাই দোকানদারদের অবস্থা সঙিন। তাঁরা ‘হাউ মাচ’টাও বোঝেন না। ক্যালকুলেটরে দাম দেখান। না থাকলে বলে দেন ‘নো হ্যাভ’। আবার ইংরেজি না জানাতে তাঁদের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না।

ওদিকে কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম অনেকাংশেই ইংরেজিকে প্রাধান্য দিয়ে পর্যটনসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজি শিখতে বলার কারণ এই নয় যে মাতৃভাষার কোনো দরকার নেই এবং এ কথা বলায় গৌরবেরও কিছু নেই যে ‘আমার বেবি তো বেঙ্গলিতে ভালো মার্ক তুলতে পারে না, ইংলিশে হানড্রেডে হানড্রেড।’ নিজের ভাষাকে অবজ্ঞা করা অশিক্ষা ও আলোকহীনতার লক্ষণ। অন্যদিকে ইংরেজি না শেখা বোকামি। শেখার ক্ষেত্রে কূপমণ্ডূকতা ঝেড়ে ফেলা জরুরি। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার এ বিশ্বে নিজেকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ইংরেজি না জানা কোনো কাজের কথা নয়।

উম্মে মুসলিমা: কবি ও কথাসাহিত্যিক
muslima.umme@gmail,com