পিপলস লিজিং অবসায়নের দায় কার

আরেক কোম্পানিকে অধিগ্রহণ বা দুটি কোম্পানি একত্রীকরণের (মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন) পরিষ্কার কোনো আইন বাংলাদেশে নেই। তারপরও এখানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে একীভূত বা একত্র হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ কার্যক্রম। তবে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনে যা–ই থাকুক, বাংলাদেশে কোম্পানি অধিগ্রহণের নিজস্ব দুটি পদ্ধতি তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবশ্য অধিগ্রহণ বা একত্রীকরণ নয়, একে দখল বলাই উচিত। প্রথম পদ্ধতিটি হচ্ছে, কোম্পানির পরিচালকদের নানাভাবে ভয় দেখিয়ে পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নেওয়া। আরেক পদ্ধতিতে কোনো একটি কারণ দেখিয়ে পরিচালকদের অপসারণ করা। এরপর ফাঁকা পদে পরিচালক হয়ে ঢুকে কোম্পানির দখল নেওয়া যে খুবই সহজ, এর একাধিক উদাহরণ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ জন্য অবশ্যই বিশেষ ধরনের সহায়তা লাগবে। হয় ভয় দেখাতে হবে, নয়তো নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারও সহযোগিতা লাগবে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ। এ জন্য প্রথমে নামে-বেনামে একাধিক কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনতে হবে। এভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ারের মালিক হলে তারপরই ওপরের যেকোনো একটি পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়। সদ্য অবসায়ন হওয়া ব্যাংক–বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয় পদ্ধতি।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কয়েকজন উদ্যোক্তা পরিচালক নানাভাবে ৩৫৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা পিপলস লিজিং থেকে অবৈধভাবে ঋণ নেন। জমি বিক্রির নামেও পিপলস লিজিংয়ের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি এবং আর্থিক অবস্থা ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখিয়ে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগও ছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। ফলে সংগত কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালের জুলাই মাসে পিপলস লিজিংয়ের পরিচালক আরেফিন সামসুল আলামিন, হুমায়রা আলামিন, নার্গিস আলামিন, মতিউর রহমান ও খবির উদ্দিন মিয়াকে অপসারণ করে। একই বছরের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) এম মোয়াজ্জেম হোসেন পদত্যাগ করেন। এরপর নতুন পরিচালকদের নিয়ে পর্ষদ পুনর্গঠন করা হলেও তাঁদের নিয়োগ দেওয়া নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

নথিপত্র অনুযায়ী, ২০১৫ সালে শেয়ার কিনে আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, ড্রাইনুন অ্যাপারেলস লিমিটেডের প্রতিনিধি কাজী মোমরেজ মাহমুদ এবং ওরিক্স সিকিউরিটিজ লিমিটেডের প্রতিনিধি নং চাও মং পিপলস লিজিংয়ের পরিচালক হতে আবেদন করেছিলেন। আনান কেমিক্যাল শেয়ারবাজার থেকে পিপলস লিজিংয়ের ১ কোটি ৪৪ লাখ ৪০ হাজার ৯০০ শেয়ার কিনেছিল ২৪ কোটি ৮ লাখ ৪৭ হাজার টাকায়। এফএএস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড নামের আরেকটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক কোম্পানির মাধ্যমে এই শেয়ার কেনা হয়। উজ্জ্বল কুমার নন্দী তখন এফএএস ক্যাপিটালের একজন পরিচালক। ২৪ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হলেও তখন আনান কেমিক্যালের পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ১ কোটি টাকা।

একইভাবে ড্রাইনুন অ্যাপারেলসও পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার ২৪ কোটি ৫ লাখ টাকায় কিনলেও তাদের পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ৫ লাখ টাকা। আর পরিচালক হওয়ার মতো পর্যাপ্ত শেয়ার ওরিক্স সিকিউরিটিজের কেনা ছিল না।

শেয়ার কেনাবেচা, অর্থের উৎস, কোম্পানির অস্তিত্ব—এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুই আমলে নেয়নি। ফলে পিপলস লিজিংয়ের নতুন চেয়ারম্যান হন আনান কেমিক্যালের প্রতিনিধি উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পরিচালক হন একই কোম্পানির আরেক প্রতিনিধি আফরোজা সুরাইয়া মজুমদার এবং ড্রাইনুন অ্যাপারেলসের প্রতিনিধি কাজী মোমরেজ মাহমুদ। ওরিক্স সিকিউরিটিজের প্রতিনিধি হিসেবে নং চাও মংয়ের আবেদন বাতিল হলেও তিনি পরে ড্রাইনুন অ্যাপারেলসের পক্ষে পরিচালক হন। পরে আবার আনান কেমিক্যালের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি পরিচালক পদে ছিলেন। ড্রাইনুন অ্যাপারেলস বা ওরিক্স সিকিউরিটিজের কোনো অস্তিত্ব এখন আর পাওয়া যায় না। আনান কেমিক্যালের একটি ওয়েবসাইট আছে বটে। সেখানে লেখা আছে, ‘দিস পেজ ইজ আন্ডার কনস্ট্রাকশন’, অর্থাৎ কাজ চলছে। একই অবস্থা পিপলস লিজিংয়েরও।

২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পরের চার বছর নতুন পরিচালকেরা প্রতিষ্ঠানটি চালানোর পরও দেউলিয়া পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন হচ্ছে। গত ১৪ জুলাই আদালতে পিপলস লিজিং অবসায়নের আরজি জানানো হয়েছে। এটাই দেশের কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের প্রথম সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির আমানতকারী ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আর এর প্রভাবে দেশের অন্যান্য ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আস্থার সংকটে পড়ে গেছে।

আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে করা আরজিতে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হওয়ার জন্য ২০১৫ সালে অপসারিত পরিচালকদের দায়ী করা হয়েছে। পরের চার বছর যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের পক্ষভুক্তও করা হয়নি। আরজিতে বলা হয়েছে, আগের পরিচালকেরা প্রতিষ্ঠানটিকে এমন খারাপ অবস্থায় নিয়ে যান যে পিপলস লিজিং আর দাঁড়াতেই পারেনি। যদিও শেষ চার বছরে ২ হাজার ৯৭৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা নতুন করে আমানত নিয়েছে, আর ঋণ দিয়েছে ১২৬ কোটি টাকা। বাকি অর্থ কোম্পানির দায়দেনা পরিশোধেই চলে গেছে। এর বিস্তারিত বিবরণ অবশ্য পিপলস লিজিংয়ের বার্ষিক রিপোর্টগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায় না।

পিপলস লিজিংয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ৯ শতাংশ, ২০১৫ সালে বেড়ে হয় ৩৪ শতাংশ আর ২০১৮ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে। খেলাপি ঋণ বেড়েছে, প্রতিষ্ঠানটি আমানতও সংগ্রহ করে তা নষ্ট করেছে। আমানতের এই টাকা কোথায় কোথায় ব্যয় হলো, তা জানাটা জরুরি।

এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ২০১৫ সালে পিপলস লিজিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক এ কে এম আমজাদ হোসেনকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পর্যবেক্ষক হিসেবে ২০১৬ সালে দেওয়া লিখিত প্রতিবেদন দিয়ে জানান, নতুন পরিচালকেরা নানা অনিয়ম করে পর্যাপ্ত নথিপত্র ছাড়া এবং মতামত উপেক্ষা করেই ১২০ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন। এই প্রতিবেদন দেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, উল্টো আমজাদ হোসেনকে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়।

কথা হয়েছে উজ্জ্বল কুমার নন্দীর সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পরে হুদাভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি দিয়ে নিরীক্ষা করা হলে নতুন করে আরও ১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা ঘাটতি ধরা পড়ে। এমন প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব ছিল না। দায়িত্ব নেওয়ার সময় জানতাম না যে এত বড় সমস্যা বের হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তখন থেকেই বিষয়টা জানত।’ উজ্জ্বল কুমার নন্দী নিজেই আগে হুদাভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানিতে কাজ করতেন। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন ‘আমি নিজেও অন্য কাউকে দিয়ে নিরীক্ষা করতে বলেছিলাম। প্রয়োজন হলে আবারও নিরীক্ষা হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, তাঁদের সময়ে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আমানত আসেনি, বরং অনেক ব্যাংক, গ্রাহক টাকা ফেরত নিয়ে গেছেন। সুতরাং বিষয়টা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা চালানো হোক।

পিপলস লিজিংয়ের আগের চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) এম মোয়াজ্জেম হোসেন মনে করেন, ২০১৫ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পর প্রতিষ্ঠানটিতে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। এরপর পিপলস লিজিং উচ্চ সুদে আমানত নেয়, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সবারই জানা। এ কারণেই আজ পিপলসকে অবসায়ন করতে হচ্ছে।

সাবেক ওরিয়েন্টাল, বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংক থেকে শুরু করে হালের পিপলস লিজিংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাঁরাই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই শাস্তি প্রাপ্য। নানাভাবে যাঁরা এ কাজে সহযোগিতা করেছেন, শাস্তি তাঁদেরও পাওনা। আর এ জন্য সবারই দায়দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন।

 ‘আন সাং হিরো’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। অনেক বড় ঘটনার নেপথ্য নায়ক তাঁরা, অথচ তাঁদের কথা কেউ বলেন না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ রকম কয়েকজন ‘আন সাং হিরো’র নাম অনেকেই জানেন। প্রথম একজনের কথা শোনা যায় ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার পতনের পর। তিনি একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থায় কাজ করতেন। একের পর এক কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে টাকা তোলার পদ্ধতি তিনিই শিখিয়েছিলেন বলে প্রচলিত আছে। সময় বদলেছে, ধরনও বদলে গেছে। তথাকথিত একীভূত বা একত্রীকরণ বা দখলের ক্ষেত্রেও সাম্প্রতিক সময়ে এ রকম কয়েকজন নেপথ্য নায়কের এটি দল তৈরি হয়েছে। এক ব্যবসায়ীর অর্থ, এক ব্যাংকারের বুদ্ধি, নীতিনির্ধারণে কয়েকজনের সহযোগিতা—এই হচ্ছে নেপথ্যের নায়কদের দল। তাঁরাই একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলের নেপথ্য কুশীলব।

দেউলিয়া পিপলস লিজিং বহু মানুষের অনিয়ম আর দুর্নীতির ফল। ২০১৫ সালে সংকট দেখা দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক দায় সেরেছিল নতুন আরেক দলের হাতে প্রতিষ্ঠানটি তুলে দিয়ে। তারপরও পিপলস লিজিং দেউলিয়া। এর দায় কার কার। বাংলাদেশ ব্যাংকই–বা কীভাবে দায় এড়াবে। জবাবদিহির জায়গাটা কোথায়?

শওকত হোসেন: প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক
[email protected]