'আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না'

কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে উঁচু পাহাড় কেটে তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গা বসতি। গত রোববার বিকেলে তোলা ছবি।  প্রথম আলো
কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে উঁচু পাহাড় কেটে তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গা বসতি। গত রোববার বিকেলে তোলা ছবি। প্রথম আলো

২৩ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেট সদর উপজেলার খাদিমনগর ইউনিয়নের বাইশটিলা এলাকায় মাছের পোনা অবমুক্তকরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের আমরা আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না।’

সোমত্ত ছেলে বা জামাতা লেখাপড়া বাদ দিয়ে অথবা শেষ করে কাজকামের কোনো ধান্দা–ফিকির না করলে অবসরপ্রাপ্ত বা অবসাদগ্রস্ত পিতা বা শ্বশুর কখনো–সখনো খাওয়ার বা অন্ন ধ্বংসের এ রকম খোঁটা দিতেন। এ রকম খোঁটায় কাতর কোনো কোনো সন্তান বা জামাতা রাগে–দুঃখে দড়ি–কলসির সন্ধান করতেন আত্মহত্যার জন্য, কেউ দেশান্তরি হওয়ার উদ্যোগ নিতেন। বলা বাহুল্য, মিয়ানমার থেকে জান নিয়ে প্রায় শূন্য হাতে পালিয়ে আসা এসব নিরুপায় মানুষের (যাঁদের অধিকাংশই নারী এবং শিশু) পক্ষে কোনোটাই করা সম্ভব নয়। সেটা কারও কাম্যও হতে পারে না। একই দিন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ একসময় কঠোর হবে। এখন তো তারা খুব সুখে আছে। কিন্তু সুখে খুব বেশি দিন থাকবে না। এরই মধ্যে টাকাপয়সা কমছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে যারা কাজ করছে, তারাও কঠোর হবে।’

রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বাংলাদেশের ঘোষিত অবস্থানের সঙ্গে মন্ত্রীর এসব বক্তব্য মর্মান্তিকভাবে অসংগতির দোষে দুষ্ট। মন্ত্রী শরণার্থীদের ফেরত যাওয়া ও দেশে গিয়ে তাদের দাবি আদায়ের তাগিদ দিচ্ছেন, তখন দেশটির মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান উ উইন ম্রা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। রিলিজিয়ন্স ফর পিস সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে জার্মানিতে অবস্থানকালে (২০ আগস্ট) জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে এক সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন। উল্লেখ্য, উ উইন ম্রা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কফি আনান কমিশনের একজন সদস্য ছিলেন। কফি আনান কমিশন সম্পর্কে তিনি জানান, ‘কমিশন থেকে আমরা ৮৮টি সুপারিশ করি, এর মধ্যে সার্বিকভাবে মানবাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়।’ সাক্ষাৎকারের এক ফাঁকে পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান হিসেবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্ন এলে তিনি বলেন, জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতির বিষয়টি জটিল এবং মিয়ানমারের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আইন তাড়াহুড়ো করে বদলানো যাবে না। আমরা কতিপয় সুপারিশ করেছি। তবে তা সময়সাপেক্ষ।

বাংলাদেশের ঘোষিত অবস্থান কী?

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনের সাধারণ বিতর্কে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারে জাতিগত নিধন চিরতরে বন্ধ, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়াসহ সংকট সমাধানে বিশ্বনেতাদের পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাবের মধ্যে ছিল—১. অবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা। ২. অতিসত্বর মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা। ৩. জাতি–ধর্মনির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা। ৪. রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। ৫. কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

পরের বছর ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘হাই লেভেল ইভেন্ট অন দ্য গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অন রিফিউজি: এ মডেল ফর গ্রেটার সলিডারিটি অ্যান্ড করপোরেশন’ শীর্ষক বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তাঁর আগের প্রস্তাবগুলোকে আরও সুনির্দিষ্ট করে তিন দফা সমাধান সূত্রের সুপারিশ তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব করেন, ক. মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আইন ও নীতি বাতিল এবং বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করার প্রকৃত কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। খ. মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নাগরিক সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে একটি ‘সেফ জোন’ (নিরাপদ অঞ্চল) প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গ. জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশের আলোকে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

রোহিঙ্গাদের ধারাবাহিকভাবে জাতিগত নিধনের হাত থেকে রক্ষা এবং বারবার বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ঠেলে দেওয়ার বার্মিজ প্রবণতা দূর করার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর এসব প্রাজ্ঞ প্রস্তাব। তিনি জানেন, সমস্যার স্থায়ী সুরাহা না করে যেনতেনভাবে বা জোর করে ফেরত পাঠালে আগের মতো আবার তাদের বাংলাদেশের দিকেই ঠেলে দেওয়া হবে।

সত্যিই কেউ কি আমাদের পাশে আছে?

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সম্প্রতি এক সভায় বলেছিলেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রগুলো এ সংকটে এগিয়ে আসবে, কিন্তু তা হয়নি। একটি দেশে গণহত্যা হচ্ছে অথচ বিশ্ব নীরব, তাদের নিজ দেশে ফেরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। কোথায় বিশ্ব, কোথায় বিশ্ব আইন-মানবাধিকার।’ যে সভায় তিনি এটা বলেন, সেখানে উপস্থিত সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা অবশ্য জানান, মিজানুর রহমানের ধারণা ঠিক নয়, তাঁর তথ্য অসম্পূর্ণ। ভেতরে-ভেতরে পর্দার অন্তরালে আমরা নাকি অনেক দূর এগিয়েছি। প্রত্যাবাসন হবে। প্রত্যাবাসন হচ্ছে হবে করে শেষ পর্যন্ত নাটক হয়েছে। নাটক শেষে কেউ গলা ছেড়ে কাশেননি। পর্দার অন্তরালে অগ্রগতির একমাত্র আলামত পাওয়া গেল বার্মিজ কূটনীতিকের ডান দিকে চীনা কূটনীতিকের মিটিমিটি উপস্থিতি। আমরা যে যা–ই বলি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আসিয়ানের পাশাপাশি রাশিয়া, চীন, ভারত ও জাপানের কাছ থেকে লিপ সার্ভিস মিললেও কার্যকরী কোনো সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়নি বাংলাদেশ।

দোষারোপ নয়, নিজেদের কাজের মূল্যায়ন প্রয়োজন

রোহিঙ্গারা রাখাইনের আশ্রয়কেন্দ্রে নয়, নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরে যেতে চায়। ভারত আর চীন রাখাইনে বানিয়েছে ক্যাম্প আশ্রয়কেন্দ্র। তাই তাদের ভয়, আশ্রয়কেন্দ্র নামের বন্দীখানায় তাদের নিয়ে যাওয়া হবে। ফিরে যাওয়ার পর নিজেদের দেশে চলাফেরার স্বাধীনতা আর জাতিসত্তার স্বীকৃতিসহ নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা চায় তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাধান ফর্মুলায় এগুলোর কথাই বলা হয়েছে। প্রবীণ নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাখাইনের রোহিঙ্গা অঞ্চলে জাতিসংঘের প্রতিনিধি হিসেবে আসিয়ান দেশগুলোর লোকদের, এমনকি চীনের লোকদের পাঠালেও তাঁরা স্বাগত জানাবেন। তবে জাতিসংঘের নজরদারি ছাড়া তাঁদের ভরসা নেই। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হলে তাদের আস্থায় নিতে হবে। খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলে কোনো কাজ হবে না। আমরা দেখলাম শেষ পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা গরম তাওয়া থেকে উনুনে ঝাঁপ দিতে রাজি হয়নি। স্থানীয় আর বেসরকারি মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধেও কোনো বিশ্বাসযোগ্য আলামত ছাড়া অভিযোগ তোলা হয়েছে। বলা হচ্ছে তাদের ষড়যন্ত্রের কারণেই রোহিঙ্গারা ফিরছে না। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বকলম রোহিঙ্গাদের ইংরেজি পোস্টার কে লিখে দিয়েছে?

হার্ভার্ড, বোস্টনে লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও সব রোহিঙ্গা যে বকলম নয়, এটা না জানাটা আমাদের সমস্যা। তা ছাড়া ’৯১–এ থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ছেলেমেয়েরা এ দেশের মাদ্রাসা–স্কুলে লেখাপড়া শিখে কাজ করে খাচ্ছে। এই বাস্তবতা না জানলে আমরা সমস্যার জট খুলব কীভাবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]