মৃত্যুদূত সুপারবাগ বনাম অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহার

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ হলো সুপারবাগ। মাত্রাতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারই এর কারণ। ছবি: রয়টার্স
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ হলো সুপারবাগ। মাত্রাতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারই এর কারণ। ছবি: রয়টার্স

এ বছরেরই সংবাদ। প্রথম আলো জানাচ্ছে, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। এই প্রতিষ্ঠানের আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ হলো সুপারবাগ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’ 

মৃত্যুকে জয় করতে না পারলেও অ্যান্টিবায়োটিক মানুষকে দিয়েছিল নতুন জীবন। অ্যান্টিবায়োটিক অণুজীব থেকে সৃষ্ট রাসায়নিক উপাদান। এটা অন্য অণুজীব বা জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারে। রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর আক্রমণ ঠেকাতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্বর্ণযুগের সূচনা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আহত মানুষ বিভিন্ন জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল। ১৯২৮ সালে স্যার আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং প্রথম জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেন। সেই থেকে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়। মানুষ প্লেগ, যক্ষ্মা, ধনুষ্টংকারের মতো কঠিন কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু এই নিশ্চয়তায় যে চিড় ধরেছে, সেটাই আজকের বিষয়।

অ্যান্টিবায়োটিকের হিতে বিপরীত ব্যবহার
স্বাভাবিকভাবে মানুষের বা প্রাণিদেহে রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা থাকে বলে জীবাণুর আক্রমণ থেকে তারা সহজেই রক্ষা পায়। তবে শিশুদের জন্মের পরপর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না। তারা অণুজীব বা জীবাণুর শিকার হয়। ঘন ঘন ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। শিশুরাও ধীরে ধীরে রোগ প্রতিরোধী হয়ে বেড়ে ওঠে। যৌবনে মানুষ শক্তিশালী হয়। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি থাকে তখন। বার্ধক্যে মানুষ দুর্বল হয়। সেই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও হারায়। একই ঘটনা ঘটে এইচআইভি/এইডস আক্রান্তদের ক্ষেত্রে। তারাও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারায়।

দুর্বল ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন মানুষের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক জীবন রক্ষাকারী। তা ছাড়া বিভিন্ন দুর্ঘটনাজনিত কাটাছেঁড়া, আগুনে পোড়া এবং অস্ত্রোপচার ও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের রোগীরা অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর নির্ভর করে থাকে। কার্যকার অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষত বা পোড়া স্থানে পৌঁছে জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলে। নতুন কোনো জীবাণুকে আক্রমণ করতে দেয় না।

কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে অ্যান্টিবায়োটিক তার বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক সীমিত ধরনের জীবাণু ধ্বংস করে, যা ন্যারো স্পেকট্রাম হিসেবে পরিচিত। আবার কিছু অ্যান্টিবায়োটিক আছে, যা অনেক ধরনের জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারে। এগুলোকে বলা হয় ব্রড স্পেকট্রাম। পেনিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর থেকে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হতে থাকে। প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে পর্যায়ক্রমে নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হতে থাকে। এগুলোর কার্যকারিতা আদি অ্যান্টিবায়োটিক থেকে অনেক গুণ বেশি। নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের চতুর্থ বা পঞ্চম প্রজন্ম বাজারে আছে। তবে ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত নয় বলে এরাও কার্যকারিতা হারাচ্ছে।

জীবাণুরা দুর্ধর্ষ হয়ে উঠছে
অণুজীব মানুষের দেহেল ভেতরে ও বাইরে এবং চারপাশের পরিবেশ, যেমন: মাটি, পানি, এমনকি বাতাসে বিরাজমান। এসব জীবাণু এতই ক্ষুদ্র যে খালি চোখে দেখা যায় না। তাই মানুষ অভ্যাসগত কারণে প্রতিনিয়তই এসব জীবাণুর সংস্পর্শে আসে এবং আক্রান্ত হয়। অণুজীব অনেক ক্ষুদ্র হলেও পরাক্রমশালী। রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব সামান্য সুযোগ পেলেই মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদকে আক্রমণ করে এবং মৃত্যু ঘটাতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে এর উপাদান রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে যায় এবং আক্রমণকারী জীবাণুকে ধ্বংস করে মানুষকে রোগমুক্ত করে।

অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার ও এর ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অণুজীববিজ্ঞানীরা লক্ষ করেন, কিছু কিছু জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীল বা রেসিস্ট্যান্ট হয়ে উঠছে। তবে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ার আগেই নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিকও বাজারে আসতে থাকে। ফলে, অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স চিকিৎসাসেবাকে পুরোপুরি ব্যাহত করতে পারেনি। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে জীবাণুরা হয়ে ওঠে সহনশীল ও অপ্রতিরোধ্য। জীবাণুদের রয়েছে অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতা। তারা পরিবেশে বিরাজমান অন্যান্য জীবাণু প্রজাতি থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে অ্যান্টিবায়োটিককে ধ্বংস করার ক্ষমতা লাভ করতে পারে।

জীবাণুদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ার কারণ অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার। এভাবেই রোগ প্রতিরোধক এই ম্যাজিক বুলেট হয়ে ওঠে অকার্যকর। উন্নত দেশে অনুমোদিত বা নিবন্ধিত ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে এবং নিবন্ধিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায় না। নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের রেসিস্ট্যান্স তৈরি হতে অনেক বেশি সময় লাগে। অ্যান্টিবায়োটিক সুরক্ষিত রাখা সুচিকিৎসার গুরুতর শর্ত।

বাংলাদেশে ওষুধ কেনাবেচা করতে নিবন্ধিত চিকিৎসকের পরামর্শ বা ব্যবস্থাপত্রের দরকার পড়ে না। এখানে বাড়তে থাকা জনসংখ্যা, অপরিচ্ছন্নতা ও অনিরাপদ পানির কারণে মানুষ সহজেই রোগের শিকার হয়। এদিকে অ্যান্টিবায়োটিকে ভালো ফল পাওয়ায় চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষ তা ব্যবহারে খুব উৎসাহিত হন। কিছু অসাধু ওষুধ বিক্রেতাও জেনে বা না জেনে সাধারণ মানুষকে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে উৎসাহিত করে থাকেন। আবার কিছু অসাধু চিকিৎসক সহজে নাম কামাতে প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে রোগীদের বাধ্য করেন। আবার রোগীদের মধ্যেও অনেকে আছেন, কোনো রোগের সুফলদায়ী অ্যান্টিবায়োটিক চিনে রাখেন। ভবিষ্যতে একই ধরনের সমস্যায় তাঁরা নিজেরাই ওই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন। এর ব্যাপকতা এতটাই বেড়েছে যে গ্রামাঞ্চলে অনেককেই পকেটে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়।

পাশ্চাত্যের বিশ্বভ্রমণকারীরা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় ভ্রমণের সময় প্রোফাইলেকটিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকেন। তবে এটি অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার, যা কোনো অবস্থাতেই উৎসাহিত করা যায় না।

ক্ষমতাধর জীবাণু ‘সুপারবাগ’
বর্তমান বিশ্বে খাদ্যের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রোটিন ও আমিষের চাহিদা বাড়ছে। কম খরচে লাভবান হওয়া যায় বলে গরু, হাঁস, মুরগি নীরোগ রাখতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে। এমনকি মাছের খাবারেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষিতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে খাদ্যসহ দুগ্ধজাত পণ্যেও এখন অ্যান্টিবায়োটিক ছড়িয়ে পড়েছে।

একদিকে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষ ও প্রাণিদেহে থাকা অণুজীবকে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্ট হতে সাহায্য করছে, অন্যদিকে কৃষিতে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক চারপাশের জলাশয়কে দূষিত করেছে। এসব রেসিডুয়াল অ্যান্টিবায়োটিক মাটি ও পানিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীবকে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্ট করে তুলছে। আর এভাবেই একটি সাধারণ জীবাণু বহুবিধ অ্যান্টিবায়োটিক–প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। অবস্থা এতই ভয়াবহ যে বর্তমানে রোগের জীবাণুকে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে ধ্বংস করা যাচ্ছে না। চরম ক্ষমতাধর এসব জীবাণু ‘সুপারবাগ’ নামে পরিচিত।

সুপারবাগ প্রাণসংহারী। একে থামানোর হাতিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক এখন অকার্যকর। সুপারবাগ এখন পরিবেশে, মানুষের দেহে, মাটিতে, পানিতে—সর্বত্র বিরাজমান। তাই সাধারণ সংক্রমণও সহজে মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। অস্ত্রোপচার করা এখন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে উঠে আসার একটিই পথ, তা হলো যেকোনো মূল্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা।

ড. মূনীরুল আলম: জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি