মুসলিম জীবনে হিজরি সালের গুরুত্ব

হিজরি সাল ১৪৪০ বিদায় নিয়ে আসছে ১৪৪১ সাল। ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান হিজরি সাল তথা আরবি তারিখ ও চান্দ্রমাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সালের ওপর নির্ভরশীল। যেসব ঐতিহাসিক উপাদান মুসলিম উম্মাহকে উজ্জীবিত করে, তার মধ্যে হিজরি সাল অন্যতম। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সভ্যতা-সংস্কৃতিতে ও মুসলিম জীবনে হিজরি সালের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি সালের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুনিক ঐতিহ্য সম্পৃক্ত। 

মানবজীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে আল্লাহ তাআলা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাস ১২টি, এর মধ্যে ৪টি নিষিদ্ধ মাস; এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান’ (৯:৩৬)। ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এগুলোর মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন’ (১০: ৫)। 

তৎকালীন আরবে সুনির্দিষ্ট কোনো সাল প্রচলিত ছিল না। বিশেষ ঘটনার নামে বছরগুলোর নামকরণ করা হতো। যেমন বিদায়ের বছর, অনুমতির বছর, হস্তীর বছর ইত্যাদি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.) যখন খলিফা হন, তখন অনেক নতুন ভূখণ্ড ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় কাগজপত্র ইত্যাদিতে সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকায় অসুবিধা হতো। 

আলবিরুনির বিবরণী থেকে জানা যায়, হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) একটি পত্রে উমর (রা.)-কে অবহিত করেন, ‘সরকারি চিঠিপত্রে সাল-তারিখ না থাকায় আমাদের অসুবিধা হয়।’ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে হজরত উমর (রা.) একটি সাল চালু করেন। আল্লামা শিবলি নোমানি (র.) হিজরি সালের প্রচলন সম্পর্কে আল ফারুক গ্রন্থে উল্লেখ করেন: হজরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সালের শাবান মাসে খলিফা উমরের কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়, পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল; সালের উল্লেখ ছিল না। 

খলিফা জিজ্ঞাসা করলেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে এটি কোন সালে পেশ করা হয়েছিল? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না পেয়ে হজরত উমর (রা.) সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীকে নিয়ে আলোচনা করে মহানবী (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের বছর থেকে সাল গণনা করার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। হিজরতের বছর থেকে সাল গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলী (রা.)। পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ হিজরি সালের শুরু করার ও জিলহজ মাসকে সর্বশেষ মাস হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেন হজরত উমান (রা.) (বুখারি ও আবু দাউদ)। 

প্রিয় নবীজি (সা.)-এর মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের ঘটনা মুসলমানদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত মানে ছেড়ে যাওয়া, পরিত্যাগ করা; দেশান্তর হওয়া ও দেশান্তরিত করা। পরিভাষায় হিজরত হলো ধর্মের জন্য এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাওয়া। নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। 

নবী করিম (সা.) জুমার দিনে মদিনায় প্রবেশ করলেন। তিনি যখন মদিনা শরিফে প্রবেশ করলেন, তখন তাঁকে বরণ করার জন্য তাঁর উটের দড়ি নিয়ে টানাটানি শুরু হলো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘উট ছেড়ে দাও। যেখানে সে বসবে, সেটাই হবে আমার বাসস্থান। তাকে এমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ উট বনু নাজ্জার গোত্রের এলাকায় গিয়ে দাঁড়াল। এখানেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নানার বাড়ি ছিল। এ গোত্রের হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়ির সামনে গিয়ে উট বসে পড়ল। এখানেই নবীজি (সা.)-এর বাসস্থান নির্ধারণ করা হলো। এখানেই গড়ে উঠল মসজিদে নববি ও মদিনাতুর রাসুল বা রাসুলের শহর (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, জাদুল মাআদ, তারিখুল ইসলাম)। 

নতুন বছরের সঙ্গে আসে নতুন চাঁদ ও নতুন মাস। নতুন চাঁদে নতুন মাসে রাসুলে খোদা (সা.) পড়তেন, ‘আল্লাহ মহান, হে আল্লাহ! এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, প্রশান্তি ও ইসলামসহযোগে আনয়ন করুন; আমাদের তৌফিক দিন আপনার মহব্বত ও সন্তুষ্টির; আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ! এই চান্দ্রমাস সুপথ ও কল্যাণের’ (তিরমিজি: ৩৪৪৭ ও ৩৪৫১, মুসনাদে আহমাদ: ১৪০০, রিয়াদুস সালিহিন: ১২৩৬)। 

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক