আজকের নববাবুদের বিলাস

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতায় ইংরেজ-ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসা যে নব্য ধনী শ্রেণি অপরিমিত বিলাসিতায় জীবন যাপন করত, তাদের নিয়ে সে সময়ে একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন লেখক ও সম্পাদক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর একটি গ্রন্থের নাম নববাবুবিলাস। সেখানে তিনি নব্য ধনীদের অসংযমী জীবনযাত্রাকে তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছেন।

বাংলাদেশে যে একটি নববাবু শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে, এটা আর কারও অজানা নয়। রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে তাদের প্রভাব স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। মাঝেমধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে তাঁদের কুৎসিত স্বরূপ। সর্বশেষ যিনি আলোচনায় এলেন, তিনি একজন জেলা প্রশাসক। তাঁর মতো দায়িত্বশীল পদের ব্যক্তির নৈতিক স্খলন দেশের ভাবমূর্তিকে লজ্জায় ফেলেছে। অবশ্য দেশে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নৈতিক স্খলনের ঘটনা নতুন নয়। আগে ছিল কদাচিৎ, এখন প্রায়ই ঘটছে।

চলতি বছরের শুরুতে পুলিশের একজন ডিআইজি পর্যায়ের কর্মকর্তা নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন। দুদক তাঁর অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের সন্ধান পেয়েছিল। সেই তদন্ত নিয়ে দুদক কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তার ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর গত জুনে পুলিশ বনাম দুদক শত্রু শত্রু খেলা হয়ে গেল। একই সময় ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে নিয়ে লুকোচুরি লুকোচুরি খেলা চলল। অবশ্য দুই পুলিশ কর্মকর্তাকেই কারাগারে যেতে হয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে দুদক কর্মকর্তাকে। তবে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে নয়, ‘তথ্য ফাঁস’–এর অভিযোগে।

২০২০ সালে পূর্ব বাংলায় জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির ৭০ বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু গত ৯ জুন হাইকোর্টের এক মন্তব্যে বলা হলো, কোথাও কোথাও এখনো জমিদারি প্রথা চালু আছে। ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যার মামলায় এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘কিছু কিছু ডিসি ও ওসি আছেন, যাঁরা নিজেদের জমিদার মনে করেন। সর্বেসর্বা মনে করেন।’ কালতালীয় হলেও সত্যি, তার এক সপ্তাহ আগে ৩০০ বছরের বেশি পুরোনো রাজা সীতারাম রায়ের একটি পালঙ্কের খোঁজ মেলে মাগুরার জেলা প্রশাসকের বাসভবনে। গত ২৫ জুলাই সরকারি আরেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা কাঁঠালবাড়ি নৌঘাটে আমলাতন্ত্রের প্রয়োগ দেখালেন। তাঁর জন্য ফেরিঘাটে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা পর অ্যাম্বুলেন্সে এক অসুস্থ ছাত্রের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হলো। তারপর হাইকোর্ট এক আদেশে বললেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দেশে কোনো ভিআইপি নেই।

চারদিকে এত স্খলন। তবু গর্ব করি, আমাদের আছে মহামান্য হাইকোর্ট। কিন্তু সেখান থেকেও মন–খারাপ–করা খবর এল। গত ২৩ আগস্ট সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, অসদাচরণের অভিযোগে খোদ হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতিকে বিচারকার্য থেকে সাময়িক বিরত রাখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনজন বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে তাদের বিচারকার্য থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা হয় এবং পরে তারা ছুটির প্রার্থনা করেন।’ [দৈনিক সমকাল]

বঙ্গীয় সমাজ আজ মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে একশ্রেণির রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, চিকিৎসক, বিচারক ও শিক্ষকের (তালিকায় কেউ কি বাদ পড়ল) নৈতিক স্খলন ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের থামানো যাচ্ছে না। তাঁদের কারণে রাষ্ট্র বারবার বিব্রত হচ্ছে। সমাজ ভারসাম্য হারাচ্ছে। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা ছিল না।

অসম সমাজ নিয়ে বহমান রাষ্ট্রব্যবস্থাও তার উদ্বেগ প্রকাশ করে চলছে। সমাজে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধনীরা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাচ্ছেন। প্রতি অর্থবছরের বাজেটে তাদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অপ্রদর্শিত আয়ের সুযোগ দিচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া এবং খেলাপি হলে ঋণমুক্ত হওয়ারও সুযোগ থাকছে। বলা ভালো, বৈধ-অবৈধ যা–ই হোক, ধনীকে আরও ধনী করার রাষ্ট্রীয় সব নীতি এখানে গৃহীত আছে।

একটি সমাজে সবার যাপিত জীবন একই রকম হবে, এমন নয়। কিন্তু রাষ্ট্র যদি নিজেই ধনিকুলের স্বার্থরক্ষায় এবং সুযোগ-সুবিধা দিতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে শ্রেণিবিভাজন প্রকট হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বঞ্চনা বোধ ও অপ্রাপ্তির হাহাকার বাড়ে। বিপরীতে অল্প কিছু মানুষের জীবন চাকচিক্যময় হয়। কারও কারও দেশের বাইরে বসতবাড়ি বৃদ্ধি পায়। সুইচ ব্যাংকে অর্থের পাহাড় জমা হয়।

প্রতিবেশী ভুটানিরা ন্যাশনাল হ্যাপিনেস বা জাতীয় সুখে বিশ্বাস করেন আর আমাদের দিন শুরু হয় সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক সিনেমার মনোমোহন মিত্রের সেই সংলাপের মতো করে। ‘হাসির খোরাক এখানে পান আপনারা? আমি সকালে সংবাদপত্র খুলে শোক সংবাদ ছাড়া আর কিছুই দেখলাম না’। অবশ্য মহামারির মতো সড়ক দুর্ঘটনার সময়ও এখানকার মন্ত্রী হো হো করে হেসে ওঠেন, ডেঙ্গু নিয়ে সারা দেশের মানুষের উৎকণ্ঠার মধ্যেই েকানো অপঘাতে কত মৃত্যু হয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেই খতিয়ান তুলে ধরেন, মনুষ্য জাতিকে কীটপতঙ্গের সঙ্গে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন।

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, নববাবুবিলাস যখন ব্রিটিশরা তাদের শোষণ টিকে রাখতে একটি বিশেষ শ্রেণিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিত। সেই ব্রিটিশ এবং পরে পাকিস্তানি শোষণ-শাসন রুখে দিতে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। বলা হয়েছিল, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। সম্পদ বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনা হবে। শোষিতের মঙ্গল, কল্যাণ আর নিরাপত্তার কথা বলে প্রণীত হয়েছিল এ দেশের শাসনতন্ত্র। কিন্তু আজ...। আমাদের কেউ কি লিখবেন দ্বিতীয় নববাবুবিলাস, যেখানে উঠে আসবে কে, কখন এবং কীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে নববাবুবিলাস শুরু করেছে, যা এখনো বিদ্যমান আছে?

জহির রায়হান : একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদকর্মী