ইরানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে কি পশ্চিমা জোট ভেঙে যাবে

গত মাসে ফ্রান্সের বিয়ারিৎসে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কাছ থেকে বাধাবিঘ্ন আসবে কি না, সে ব্যাপারে টস করা হয়েছিল। সে রকম কিছু না ঘটলেও সম্মেলনে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়ে যিনি সবাইকে চমকে দিয়েছেন এবং যিনি একেবারেই প্রত্যাশিত ছিলেন না, তিনি হলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ।

শীর্ষ সম্মেলনে বাণিজ্যযুদ্ধ, আমাজনের আগুন এবং চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিটের আসন্ন বিপদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ইরান সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে ভালো আলোচনা হয়েছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড সীমিত করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালের করা চুক্তি থেকে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসে। আরোপ করে ইরানের ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এর মধ্যে উপসাগরীয় এলাকায় তেলের ট্যাংকারে হামলা, ড্রোন ভূপাতিত করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কে এখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইরানের সঙ্গে এই দ্বন্দ্ব পশ্চিমাদের জোটকে কি ভেঙে ফেলবে? কেননা, পারমাণবিক চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী ফ্রান্সসহ অন্য পাঁচটি দেশ এখনো চুক্তিটি বহাল রাখার পক্ষে।

বিয়ারিৎস সম্মেলনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার চলমান উত্তেজনা নিরসনের পথ উন্মুক্ত করেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ইরান নাটকের প্রধান খেলোয়াড়েরা সবাই যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে পিছিয়ে এসেছে। যুক্তরাজ্য জিব্রাল্টার প্রণালিতে আটক করা ইরানি ট্যাংকার ছেড়ে দিয়েছে এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ট্রাম্প ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে বৈঠক করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তা সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি কারণে যুদ্ধের আশঙ্কা হ্রাস করার উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন এখনো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ইরানের (এবং আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্রদের) ওপর যত বেশি চাপ দেওয়া হবে, ততই ভালো হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন বিশেষ করে ইরানের অর্থনীতির শ্বাস রোধ করতে চান এবং বিশ্বাস করেন যে ইউরোপ থেকে যেকোনো ধরনের সাহায্য–সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়াই হবে এটি করার একটি ভালো উপায়।

ইরানের কট্টরপন্থীদের মধ্যেও সমস্যা রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে মনে করে যে তারা পারমাণবিক চুক্তি মেনে চলে কিছুই লাভ করতে পারেনি এবং এই যুক্তিতে ইরানের নেতারা গত মাসে হরমুজ প্রণালিতে একটি ব্রিটিশ ট্যাংকার আটক করেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি স্থানে বিশৃঙ্খলামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। ইরানের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন ইতিমধ্যে ইসরায়েলকে ক্ষুব্ধ করেছে। এ কারণে তারা ইরাকে ইরানি সম্পদগুলোকে টার্গেট করছে (সিরিয়ায় ইতিমধ্যে ইরানি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল)। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইউরোপ ও ইরানের মধ্যে বাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়ার জন্য একটি ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে ইউরোপের ধীর অগ্রগতি দেখে ইরান হতাশ হয়ে পড়েছে। তবে ইরানের যাঁরা দাবি করেন যে তাঁরা ইউরোপ থেকে কিছুই পাননি, তাঁরা ভুল বলছেন। প্রকৃতপক্ষে ইরান যদি তার আগ্রাসনের নীতি অব্যাহত রাখে, তাহলে তারা ইউরোপের সমর্থন হারাতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থাকার পরও ইরান পারমাণবিক চুক্তির পক্ষে ইউরোপের সমর্থন বজায় রাখার বিষয়টি অনেককে অবাক করেছে। এমনকি ব্রিটিশ সরকারও এখন পর্যন্ত ইইউর অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে চলেছে। কিন্তু এ অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে। ইরান যদি আবারও ব্রিটিশ জাহাজ আটক করে এবং যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের জিম্মি করে রাখে, তবে তা বরিস জনসনকে ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান গ্রহণ করতে প্ররোচিত করতে পারে। এসব ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মাখোঁ ট্রাম্পকে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেছেন, যদি ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম বন্ধ করার পাশাপাশি পারমাণবিক চুক্তি মেনে চলে এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে আরও আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করে। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো ধরনের বৈরী আচরণ ইরানিদের আলোচনার টেবিল থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে এবং ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের প্রচারের মাঝামাঝি সময়ে সামরিক লড়াইয়ের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

ইউরোপীয়দেরও অবশ্য ইরানিদের এটা বোঝাতে হবে যে তারা যেন তাদের নিজস্ব ক্ষমতাকে অতি মূল্যায়ন না করে। তবে ইউরোপীয়রা যদি ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য সহজতর করতে না পারে, তাহলে ইরানে তার বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পাবে। ইউরোপের উচিত ইরানকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখা,
তবে তাদের এটাও স্পষ্ট করতে হবে যে ইউরোপীয় কোনো স্বার্থে বা স্থাপনায় ইরান যদি আবারও হামলা চালায়, তাহলে ইইউ বাধ্য হবে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল অবলম্বন করতে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত 

মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক