শিশু আইনে যখন 'বিচারিক বিশৃঙ্খলা'

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি পশ্চিমবঙ্গে শিশু আদালত উদ্বোধন করতে এসে বলেছেন, ভারতে যত শিশু অপরাধ করে, তার চেয়ে তিন গুণের বেশি শিশু নির্যাতন বা সহিংসতার শিকার হয়। বাংলাদেশে এ অনুপাত কত, তার পরিসংখ্যান জানা যায় না। তবে শিশু আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কমিটি ও ইউনিসেফ আয়োজিত একটি আলোচনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। ১৯২২ সালের আইন বলেছিল, শিশুদের জন্য আলাদা আদালত করতে হবে। এ আদালত মোটেই প্রচলিত আদালত নয়। আসলে আদালত বলতে যে চিত্র মনে ভেসে ওঠে, এটা মোটেই তা 

নয়। সেই অর্থে একে ‘আদালত’ বলাই একটি অসংগত বিষয়। 

পারিবারিক আবহাওয়ায় শিশুর ‘সাত খুন’ মাফ। আমরা শিশুদের বহু অন্যায় আবদার মেনে নিই। কিন্তু সেই মহা আদরের শিশু যখন পরিবারের বাইরে আইনের সংঘাতে আসে অর্থাৎ লঘু-গুরু শাস্তিযোগ্য কোনো কর্মকাণ্ডে জড়ায়, তখন আমরা তাকে মুহূর্তে ভুলে যাই। তাকে শিশু না ভেবে একজন অপরাধী ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চাই না। আর আমাদের পারিপার্শ্বিকতা, ব্যস্ততাপূর্ণ জীবনে শিশুদের জন্য আলাদা একটি জগৎ তৈরির প্রয়োজনীয়তা কী, সেটা করতে অপারগ থাকার পরিণতি কী হতে পারে, তা আমরা অগ্রাহ্য করে চলেছি। 

বাংলাদেশের জনসংখ্যার কমপক্ষে সাত কোটি শিশু। এর মধ্যে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ শিশু আইনের সংঘাতে আসার দায়ে তিনটি সংশোধন কেন্দ্রে আছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো এর মধ্যে দণ্ডিত শিশুর সংখ্যা অনধিক ৫০। তার মানে ৯৫ ভাগের বেশি শিশুই বিনা বিচারে মাসের পর মাস কাটাচ্ছে। তাদের যে পরিবেশে রাখা হয়েছে, তা বুঝতে এই একটি তথ্য যথেষ্ট যে ২০০ শিশু ধারণক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রে রাখা হয়েছে ৪০০ জনকে। 

সম্প্রতি একটি শিশু ‘জামিন’ চাইতে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়। আর সেই মামলাতেই গত ১ আগস্ট হাইকোর্ট বিস্ময়ের সঙ্গে খোদ শিশু আইনে ভীষণ গরমিল দেখতে পান। ২০১৩ সালের শিশু আইন, যা অনেক চিন্তাভাবনা এবং গবেষণার পরে ২০১৮ সালে সংশোধন করা হয়েছিল, সেটিকে হাইকোর্ট কয়েকটি বিশেষণে ভূষিত করেছেন। এই বিশেষণগুলো আমাদের সংসদের চোখ খুলে দিলে আমরা বাধিত হব। শিশু আইনটি কেমন? হাইকোর্টের ভাষায়, ক. এটি অন্যান্য আইনের সঙ্গে ‘শুধু অসংগতিপূর্ণ নয়, সাংঘর্ষিকও বটে’। খ. এটি এমন একটি অবস্থা তৈরি করেছে, যা ‘বাস্তবতাবিবর্জিত এবং অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক’। এরপর হাইকোর্ট বলেছেন, ‘শিশু আইন ও আদালত নিয়ে বর্তমানে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগে একধরনের বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।’ অপ্রিয় হলেও শিশুর উন্নয়নে সংসদ ও সরকারের অঙ্গীকার কতটা ঠুনকো হতে পারে, সেটা এ আইন একটি সাক্ষ্য বহন করছে। 

আইনটি ছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। নিয়ম হচ্ছে তাদের পাঠানো খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং উইংয়ে যাবে এবং ভেটিং করতে গিয়ে তাদেরই এটা দেখার দায়িত্ব যে অন্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলো কি না। যে শিশু আইনটি হয়েছে, তা নানা দোষে দুষ্ট। কোনো শিশু চুয়াত্তরের বিশেষ ক্ষমতা আইন, ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধ করতে পারে। তিনটি বিশেষ আইনই বলছে, সংশ্লিষ্ট আদালত বা ট্রাইব্যুনাল বিচার করবেন। কিন্তু শিশু আইনের শর্ত মানলে তারা তা করতে পারবে না। এমন অবস্থাও তৈরি হয়েছে, একই আইনে শিশু হলে অপরাধ আমলে নেবেন ম্যাজিস্ট্রেট, প্রাপ্তবয়স্ক হলে ট্রাইব্যুনাল। 

স্পষ্টতই এটা নীতিনির্ধারণী কোনো বিষয় নয়। এটা কারিগরি বিষয়। সুতরাং এ রকম বিধান যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁদের দক্ষতা প্রশ্নসাপেক্ষ। অথচ শিশু আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে সুপ্রিম কোর্টের শিশু অধিকারবিষয়ক বিশেষ কমিটি ও ইউনিসেফ আয়োজিত সেই আলোচনা সভায় আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দাবি করলেন যে তাঁদের খসড়া ঠিকই ছিল, সংসদ সচিবালয়ে গিয়ে বদলে গেছে। বিষয়টি অস্বাভাবিক। আলোচনা সভায় সংসদ সচিবালয়ের ড্রাফটিং উইংয়ের একজন প্রতিনিধি থাকলে তার অবস্থানটি জানা যেত। তাই বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে। এটি সংসদের মর্যাদার প্রশ্ন। 

ওই রায় পড়ে এবং আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারী তিনটি বিভাগের নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের বিচারক, প্রসিকিউটরদের নানা জিজ্ঞাসা শুনে প্রতীয়মান হয় যে শিশু আদালতের ধারণা এবং শিশু আইনে বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রায়োগিক জানা–বোঝায় বিরাট ঘাটতি। সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সিংহভাগের মাইন্ডসেট হলো শিশুকে আলাদাভাবে না দেখা। শিশুদের জন্য আলাদা আদালত গঠন না করা। এর ধারাবাহিকতা সেই ১৯২২ থেকেই চলছে। যদিও বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭৪ সালেই ১৯২২ সালের বেঙ্গল চিলড্রেনস অ্যাক্ট রদ করে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করা হয়েছিল। কিন্তু পরের ইতিহাস বলছে, কোনো সরকারই শিশুদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়নি। বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। 

আইন বলছে, শিশু আদালত করতে হবে। সরকারগুলো (১৯২২ থেকে) কখনই তা না করে গোঁজামিল দিয়েছে। শিশু আদালতে সালুঘেরা এজলাস, কাঠগড়া কিছুই থাকবে না। অথচ একই এজলাসে অন্য মামলার শুনানি স্থগিত করে বিচারকেরা শিশু মামলার বিচার করতে বসেন।
আইন তা বলে না। ২০১৮ সালের পরে আবার প্যাঁচ কষা হলো। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে এখন দেড় থেকে দুই লাখ পুরোনো মামলার বোঝা। কয়েকজন ট্রাইব্যুনাল বিচারক সভায় বললেন, তাঁদের কাছে পাঁচ-ছয় হাজারের বেশি পুরোনো মামলা জমে আছে। তাঁদের প্রশ্ন, এর ওপরে ২০ হাজারের মতো শিশু মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কীভাবে সুরাহা করা সম্ভব?

স্বল্পমাত্রার বিচার বিভাগীয় বাজেট, দুর্বল প্রশাসনিক অবকাঠামো ও বিচারকস্বল্পতার কারণে দেশে প্রতিটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের ঘাড়ে একাধিক দায়িত্বের বোঝা চাপানো আছে। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, দেশে এবার আলাদা শিশু আদালত হবে। তাই অনেকে মনে করেছিলেন, সেটা বাস্তব হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালগুলোকে তঁাদের কাজের অতিরিক্ত হিসেবে শিশু আদালত করা হলো। কিন্তু এতে গতি আসছে না। আইনের যা মর্মার্থ, তাতে পারতপক্ষে কোনো শিশুকে থানা-পুলিশ–আদালতের বারান্দায় না হাঁটাতেই উৎসাহিত করেছে। একান্ত বাধ্য না হলে (যেমন খুন করে বসা) আইনের সংঘাতে আসা ১৮ বছরের নিচের শিশুকে গ্রেপ্তার, জামিন, রিমান্ড, কাঠগড়ার মতো প্রক্রিয়ার মধ্যে শিশুকে নেওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবে তেমন বোঝাপড়ায় বিরাট ঘাটতি চলছে। বিচারকেরা পর্যন্ত অসচেতন। সে কারণে প্রধান বিচারপতিকে বিচারকদের সতর্ক করে পরিপত্র দিতে হচ্ছে। বিদেশে শিশু আদালত একটি সুসজ্জিত ভুবন। বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে বিচারকদের খাসকামরাগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে। 

কোনো সন্দেহ নেই, শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং শিশুদের অপরাধে জড়ানো—দুটিই ক্রমবর্ধমান। শিশুদের মধ্যে আবার মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে আরও বেশি ভঙ্গুর দশা প্রকাশ পাচ্ছে। ১ সেপ্টেম্বর খবর বেরিয়েছে, খুলনায় গত আট মাসে ৭২টি ধর্ষণের ঘটনায় শিশুরই ৪৭। আমরা বড়রা আমাদের জীবনে ইন্টারনেট ও সামাজিক মিডিয়ার যুগের অভিঘাত নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, তার চেয়ে অনেক বেশি বিচলিত হওয়ার কথা শিশুদের ওপর ইন্টারনেটের অভিঘাত নিয়ে বহু গুণে বেশি সতর্ক হওয়া। আর এরই অংশ হিসেবে আমাদের দুটি দিকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি মাত্রায় মনোযোগ দিতে হবে। ৩০ লাখের বেশি মামলার যে বোঝা, সেই মামলা-পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে থাকা শিশুদের মামলাগুলো বের করে আনতে হবে। আইনের সংঘাতে আসা শিশু এবং ভিকটিম শিশুর সুরক্ষায় সবচেয়ে বেশি সচেতন করতে হবে পুলিশকে। দেশের বেশ কিছু স্থানে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা বিরোধীয় পক্ষগুলোকে সালিসে আনছেন। মামলায় নিরুৎসাহিত করছেন। এ ধরনের সৎ উদ্যোগগুলো আশাবাদের নতুন জায়গা তৈরি করতে পারে। 

ওই আলোচনা সভায় আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. ইমান আলীর দেওয়া অভিমতের সঙ্গে আমরা একমত। মালাউয়ি আমাদের চেয়ে ধনী দেশ নয়। তারা গরিব। সেখানেও আলাদা শিশু আদালত চলছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আইনমন্ত্রী জনসমক্ষে শিশু আদালত গঠনের কথা বলে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করলেন। এটা সংগতিপূর্ণ হলো না।’ ওই দিনই রাতে দেখা হলে আইনমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলাম। তিনি ইঙ্গিত দেন, এটা তাঁর পরিকল্পনায় আছে। এর আগে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, সরকার আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তির বিকল্প ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে। আমরা মনে করি, শিশু আদালত হতে পারে বিকল্প বিচারের রোল মডেল। 

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক