ভাদ্রের ভরাকটাল মোকাবিলায় আমরা কি তৈরি?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

নিম্নচাপজনিত ঘূর্ণিঝড়ে সাগর উত্তাল হলে অস্বাভাবিক উচ্চতায় চলে যায় সাগরের পানি। জোয়ারের লাগামছাড়া উচ্চতায় ডুবে যায় জনপদ, ভেসে যায় জীবন আর জীবনের সব অবলম্বন। তবে নিম্নচাপের প্রভাব ছাড়াও বছরে অন্তত একবার জোয়ার তার স্বাভাবিক উচ্চতার ওপরে উঠে চারদিক সয়লাব করে দিতে পারে। এটি ঘটে শ্রাবণ-ভাদ্রের পূর্ণিমা-অমাবস্যার তিথিতে। 

এবার সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে পূর্ণিমা (মধুপূর্ণিমা)। ভাদ্রের পূর্ণিমা আর অমাবস্যা তিথিতে সাগরের জোয়ারকে উপকূলের মানুষ বড় ভরাকটাল বলে থাকে। তিথি অনুসারে জোয়ার–ভাটা বাড়ে ও কমে। প্রকৃতির নিয়মে সাগরে প্রতি মাসে দুবার ভরাকটাল (স্প্রিং টাইড) বা বড় জোয়ার হয়। অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে সূর্য ও চাঁদের মিলিত শক্তির টানে যে তীব্র জোয়ার সৃষ্টি হয়, তাকে ভরা জোয়ার বা তেজকটাল বা ভরাকটাল বলে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় সূর্য, চাঁদ এবং আমাদের পৃথিবী প্রায় একই সরলরেখায় চলে আসে। অমাবস্যার সময় পৃথিবীর একই পাশে চাঁদ ও সূর্য এবং পূর্ণিমার সময় সূর্য ও চাঁদের মাঝে পৃথিবী অবস্থান করে। তাই এই দুই সময় সূর্য আর চাঁদের মিলিত আকর্ষণে জোয়ারের জায়গায় খুব বেশি মাত্রায় জলস্ফীতি হয় এবং ভাটার টানে জলস্তর বেশি মাত্রায় নেমে যায়। তবে ভাদ্রের পূর্ণিমা-অমাবস্যার জোয়ারের তেজ অন্য রকম। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের গাফিলতি আর অপ্রস্তুতিতে সেই তেজ যেন অসীম হয়ে উঠেছে। রুগ্‌ণ-ক্ষয়িষ্ণুপ্রায় পরিত্যক্ত বাঁধ, বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেট উপচে জনপদে ঢুকে পড়ছে সাগরের লোনাপানি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উপকূলের মানুষ। গত বছর ভাদ্রের জোয়ারে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, হালিশহর, খাতুনগঞ্জ, চকবাজার, বাকলিয়া, রাজাখালী, চান্দগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকা হাঁটুপানিতে প্লাবিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে যায়। পানিতে সয়লাব হয় দোকানপাট, গুদাম ও বসতবাড়ি। ভেসে যায় সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ। বেড়িবাঁধের ২০০ মিটারের বেশি জায়গা ভেঙে গিয়ে জোয়ারের পানিতে তিনটি গ্রাম পুরো প্লাবিত হয়। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ ঘোড়ামারা (পাকা মসজিদ) এলাকার ভাঙন ছিল সবচেয়ে বেশি। 

ভাদ্রের জোয়ার নতুন কিছু নয়, কিন্তু এখন কেন এমন ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাবে সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মনির আহমেদ বলেছিলেন, বেড়িবাঁধটি রক্ষণাবেক্ষণ না করা ও জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোয় বড় বড় স্ক্র্যাপ জাহাজ উপকূলে নোঙর (বিচিং) করানোর কারণে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে সম্প্রতি প্রবল জোয়ারের চাপ আর আগের মতো সহ্য করতে পারছে না। এই সময় মহেশখালীর ধলঘাটা, টেকনাফের সেন্ট মার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপ, কুতুবদিয়ার দক্ষিণ ধুরুং, উত্তর ধুরুং, তবেলারচর, চকরিয়ার মাতামুহুরীসহ কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া, চরপাড়া ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। ঘরবাড়ি, বীজতলা ও সবজিখেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কুতুবদিয়া উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধের ভাঙা ২১ কিলোমিটার আজও সম্পূর্ণ মেরামত হয়নি। এ কারণে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে সব ভরাকটালেই। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর তাদের নিয়োগদাতাদের ঢিমেতালে চলার নীতিতে মানুষ দিন দিন আস্থা হারিয়ে ফেলছে। 

এবার পবিত্র কোরবানি ঈদের সময় বাড়িতে ঈদ করতে আসা দ্বীপবাসী, বিশেষ করে যুবকেরা স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়িবাঁধের একটি অংশ মেরামতের চেষ্টা করেছিলেন। কুতুবদিয়া বাঁধের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মুরালিয়া–কুমিরাচরা অংশে ৫০০ মিটার এলাকা জরুরি ভিত্তিতে পানি ঠেকানোর জন্য বাঁশের খাঁচা তৈরি করে তার মধ্যে বালুর বস্তা দিয়ে একটা অন্তর্বর্তীকালীন চেষ্টা তাঁরা করেছেন। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, স্থানীয় সাংসদ এবং একটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান কোস্ট ট্রাস্ট যুবসমাজের এ উদ্যোগকে নানাভাবে সহযোগিতা করে। কুতুবদিয়ার উদ্যোগ বলে দেয়, মানুষ শুধু যুক্ত হতে নয়, শ্রম দিতেও প্রস্তুত। 

খুলনার দুঃখ কয়রা অঞ্চলের মানুষ এ রকম একটা উদ্যোগ নিতে এককাট্টা হয়েছে। তারা উত্তর আর দক্ষিণ বেতকাশির বাঁধটা নিজেরা বাঁধতে আর রক্ষণাবেক্ষণ করতে চায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে অনুমতির ফাইল পড়ে আছে অনেক দিন। গত বছর ভাদ্রের কটালে প্লাবিত হয়েছিল কয়রা, এখনো মেরামত হয়নি সে ভাঙা বাঁধ। সেখানকার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনপদ গাতাখালীর মানুষের এখন প্রার্থনা ছাড়া আর কীই–বা করার আছে। একইভাবে আতঙ্কে আছে শরণখোলার সাউথখালীর অরক্ষিত জনপদ। ভাদ্রের ভরাকটালে বলেশ্বর ফুঁসে উঠলে তাদের সব যাবে। আশঙ্কায় আছে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গাবুরার মানুষ। ঘুম নেই খুলনার দাকোপের নলিয়ান ছুতারখালীর মানুষের। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের বেড়িবাঁধের নিরাপত্তা নেই। ভাদ্রের পূর্ণিমা–অমাবস্যার জোয়ার সমাগত। 

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক