রোহিঙ্গা শরণার্থী: সরকারের হতাশা বনাম সংকট নিষ্পত্তি

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান কঠোর হচ্ছে
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান কঠোর হচ্ছে

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার যে ক্রমাগতভাবে হতাশার মধ্যেই নিপতিত হয়েছে এবং ক্ষুব্ধ ও অধৈর্য হয়ে পড়েছে, জার্মান বেতার ডয়চে ভেলেকে দেওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারেই সেটা স্পষ্ট। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো যদি রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরে রাজি না হয়, তবে তাদের চলে যেতে বলা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। ডয়চে ভেলের প্রতিনিধি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, জাতিসংঘের সংস্থাগুলো যদি বাংলাদেশের পরিকল্পনা সমর্থন না করে, তাহলে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে কি না? এই প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয়, আমরা তা–ই করব।’ এই সাক্ষাৎকারের মূল কথাটা জাতিসংঘের উদ্দেশে, ‘রোহিঙ্গা স্থানান্তর সমর্থন করো, নইলে দেশ ছাড়ো।’ এই কথাগুলোকে আর যা-ই হোক, কূটনৈতিক ভাষায় ক্ষোভের প্রকাশ বলা যাবে না।

এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য—‘রোহিঙ্গাদের আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না’ (প্রথম আলো, ২৩ আগস্ট ২০১৯)—এ রকম ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে সরকার আর ধৈর্যশীল থাকতে পারছে না। কিন্তু এ কথা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনার পর এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে অনীহার প্রেক্ষাপটে গত ২৯ আগস্ট বাংলাদেশে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক করেন। তাতে মনে হচ্ছিল যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ২৩ আগস্টের কথা নেহাতই কথার কথা, খানিকটাই দেশের ভেতরে মানুষদের ইঙ্গিত দেওয়া যে কোনো কোনো মহলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে ক্ষোভ আছে, সরকার সেগুলো ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছে। আমরা জানি, যেকোনো সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য দেশের বাইরের শক্তিগুলোকে দেশের অবস্থান জানানো; এ ধরনের অবস্থানের সঙ্গে একই বিষয়ে অভ্যন্তরীণ কথাবার্তার সঙ্গে সামান্য পার্থক্য থাকতেও পারে। অভ্যন্তরীণভাবে নেওয়া অবস্থান এবং বাইরে বলা অবস্থানের পার্থক্য সব সময় ইতিবাচক বলে মনে করা হয় না, কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তাকে একেবারে অগ্রহণযোগ্য বলেও বাতিল করে দেওয়া হয় না। তার কারণ, একটি সরকারের কথাবার্তার ও আচরণের একটি শ্রোতাগোষ্ঠী হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরের নাগরিকেরা, যাকে বলা হয় ডোমেস্টিক কনস্টিটিউয়েন্সি। যেসব সরকার রাজনৈতিকভাবে দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়, সেসব সরকার দেশের ভেতরের সমর্থকগোষ্ঠীর কথা বেশি বিবেচনা করে। ফলে তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের আচরণের ঘটনা ঘটে বেশি। কিন্তু এটা প্রত্যাশিত যে আন্তর্জাতিক ফোরামে যেকোনো দেশের ঘোষিত অবস্থান একধরনের প্রতিশ্রুতি বলে গণ্য হবে এবং সরকার তা পালনে বদ্ধপরিকর থাকবে।

এই বিবেচনায়ই কূটনীতিকদের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন আন্তর্জাতিক সমাজকে আরও বেশি ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিবিসির প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলেছেন, তারা যেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে (বিবিসি, ২৯ আগস্ট ২০১৯)। এই অবস্থান সহজেই বোধগম্য। কেন সংকট শুরুর দুই বছর পর এসে এই কথাগুলো আবারও বলতে হচ্ছে, সেই বিষয়ে আগেও অনেকবার আলোচনা হয়েছে। তা সত্ত্বেও কূটনীতির বিবেচনায় এটাই হচ্ছে সঠিক অবস্থান। কেননা, আন্তর্জাতিক সমাজ এখনো যতটা ভূমিকা পালন করতে পারে, ততটা করছে, এমন নয়।

জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন তথ্যানুসন্ধানী দলের যে প্রতিবেদন ৫ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছ, রোহিঙ্গাদের হত্যা ও বিতাড়নের মাধ্যমে গণহত্যা সম্পন্ন করতে ৪৫টি কোম্পানি ও সংস্থা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে অন্তত ১ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার দিয়েছিল। ওই কোম্পানি ও সংস্থাগুলোই পরে রাখাইন রাজ্য পুনর্গঠনের কাজ পেয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের শেষ চিহ্নগুলো পর্যন্ত তুলে ফেলেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের কথা জেনেও ভারত, ইসরায়েলসহ অন্তত ৭টি দেশ ও ১৪টি বিদেশি ফার্ম অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশের উচিত সেসব বিষয়ে আলোকপাত করা।

কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম, বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে সহযোগিতা চাওয়ার ১০ দিন না যেতেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘকে একটি আলটিমেটাম দিলেন। কিন্তু কেন এটাকেই যথাযথ মনে হলো, সেটা বিবেচনার বিষয়; বিস্ময়করও বটে। এই সাক্ষাৎকার যদি অভ্যন্তরীণ কোনো গণমাধ্যমকে দিতেন, তবে এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত না হলেও আমরা তাকে দেশের ভেতরের সমর্থকগোষ্ঠীর জন্য ‘কথার কথা’ বলেই বিবেচনা করতে পারতাম। কিন্তু আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমে দেওয়া এই মন্তব্যকে আনুষ্ঠানিক সরকারি অবস্থান বলেই মনে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের বক্তব্য কি আদৌ সংকট নিরসনে সহায়ক হবে?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও অভিযোগ করেছেন, ‘জাতিসংঘ আমাদের বেশি সাহায্য করছে না। তারা মিয়ানমারের রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারছে না। জাতিসংঘের এই সংস্থাগুলো কেন মিয়ানমারে কাজ করছে না? তাদের মিয়ানমারে যাওয়া উচিত, বিশেষ করে রাখাইনে। সেখানে এমন পরিবেশ তৈরি করা উচিত, যা রোহিঙ্গাদের ফিরতে সহায়তা করতে পারে। জাতিসংঘের কাছ থেকে আমরা যে কাজ প্রত্যাশা করি, তা জাতিসংঘ করছে না।’ এটা ঠিক যে কাঠামোগত কারণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোনো রকম ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। মানবিক বিবেচনায় এটা দুর্ভাগ্যজনক বললেও কম বলা হবে। এর জন্য আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের সমালোচনা করব।

কিন্তু এটা কি কেবল জাতিসংঘের ব্যর্থতা বলেই বিবেচিত হবে? বাংলাদেশের পক্ষে কেন সর্বোচ্চ অনুকূল বিশ্বজনমত থাকা সত্ত্বেও দুই বছর আগে বন্ধুদেশগুলোকে পাশে পাওয়া যায়নি কিংবা এখনো তারা কী অবস্থান নিচ্ছে কিংবা তাদের বাদ দিয়ে কেন পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একধরনের একত্র-পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি, সেসব প্রশ্ন আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এসব সত্ত্বেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, জাতিসংঘ আমাদের সাহায্য করছে না, তখন কি তিনি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাকেও বিবেচনায় নিয়েই বলেছেন? ত্রাণ তৎপরতা থেকে শিক্ষা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমে যুক্ত জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যদি সত্যি দায়িত্ব পালনে অক্ষম, অপারগ, অনীহ বা ব্যর্থ হয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশের উচিত এখনই আনুষ্ঠানিকভাবে সেগুলো সংশ্লিষ্ট ফোরামেই কেবল নয়, প্রকাশ্যে জানানো। এর কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। অন্যথায় মনে হবে বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিরুদ্ধে একধরনের মুখোমুখি অবস্থান নিচ্ছে, এটি অবশ্যই ইতিবাচক নয়। মনে রাখতে হবে, এ ধরনের বক্তব্য শরণার্থীরাও শুনছে। তাদের যেন এই ধারণা না হয় যে বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের টানাপোড়েনের কারণেই তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটছে না, তবে তা হবে ভয়াবহ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কঠোর কথাগুলোর পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিতও সুস্পষ্ট। রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সভার বরাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, সরকার ইতিমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ৪১টি এনজিওকে রোহিঙ্গা শিবির থেকে প্রত্যাহার এবং সারা দেশে দুটি এনজিওর কার্যক্রম বাতিল এরই অংশ। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় থ্রি–জি, ফোর-জি ইন্টারনেট সেবাও রাতের বেলা বন্ধ রাখা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মুঠোফোন ব্যবহার নিয়ে সরকার অসন্তুষ্ট। ‘ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ প্রতিহত করতে জেলার আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির নির্দেশে গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একসঙ্গে কাজ করবে’ বলেও বলা হচ্ছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ দমনের জন্য শিবিরগুলোকে ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার প্রস্তাব করেছে সেনাবাহিনী (ডেইলি স্টার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। সরকারের এসব ব্যবস্থা ও কথাবার্তা আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার প্রয়োজন বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবে না, কিন্তু জোর করে স্থানান্তর বা বাধ্যতামূলক প্রত্যাবাসনের চেষ্টা যেমন অগ্রহণযোগ্য হবে, তেমনি শিবিরগুলোকে কাঁটাতারে ঘেরা যোগাযোগবিচ্ছিন্ন জনপদে পরিণত করলে সেই চিত্র আন্তর্জাতিকভাবে নেতিবাচক ধারণা দেবে। গত দুই বছরে এ বিষয়ে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে এবং যেভাবে বাংলাদেশের মহানুভবতার কথা প্রশংসিত হয়েছে, এসব পদক্ষেপ তার বিরুদ্ধেই যাবে। বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তাঝুঁকি হিসেবে তুলে ধরে, তবে মিয়ানমারের যুক্তিই সঠিক প্রমাণিত হয় যে এদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া সঠিক ছিল।

সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ ও কথাবার্তা কেবল দেশের বাইরের বিবেচনায়ই বিপজ্জনক, তা নয়, এর চেয়ে বেশি বিপদ হবে অভ্যন্তরীণভাবে। সরকার ও সরকার-সমর্থকেরা একযোগে এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে এমন ধরনের প্রচার করছে যে তাতে মনে হয়, এই এনজিওগুলো সরিয়ে দিতে পারলেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। এমনভাবে বলা হচ্ছে, যেন এখন কথিত ‘কঠোর’ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যকীয়। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে রোহিঙ্গা, এনজিওগুলো এবং জাতিসংঘকে যুক্ত করার বিকল্প নেই। পরিবেশ রক্ষা থেকে নিরাপত্তা—সব বিষয়ই বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু এগুলোকে শরণার্থীবিরোধী প্রচারণা ও উসকানির হাতিয়ারে পরিণত করা হলে তার পরিণতি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্যই ক্ষতিকর হবে।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর