আমরা কিছুই দেখি না, কিছুই শুনি না...

আয়েশা সিদ্দিকা। ফাইল ছবি
আয়েশা সিদ্দিকা। ফাইল ছবি

বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড এবং এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দায়ের করা মামলা নিয়ে চলছে নানা ধরনের ক্ষমতার চর্চা। ঘটনাটির আগাগোড়া বিশ্লেষণ করলে আমরা আসলে কী বুঝি? আমরা অনেক কিছুই বুঝে যাই কিন্তু সবকিছু যে বলতে মানা! আমরা সবাই এক ভয়ের সংস্কৃতিতে বসবাস করছি। আমরা বুঝলে, জানলেও বলতে পারি না, অনেক কিছু দেখলেও জানাতে পারি না। আমরা ভয় পাই, ভীষণ রকমের ভয় পাই।

বাংলাদেশে বেশ কিছু বিষয়ে বিশেষ বিশেষ ধরনের ক্ষমতার চর্চা আছে। ক্ষমতাহীনরা অনেক সময়ই ন্যায়বিচার পান না, যাঁরা পান সংখ্যায় তাঁরা একেবারেই কম। প্রায়ই দেখা যায়, ক্ষমতাবানেরা বিচারের আওতাধীন হন না। হলেও সেটি হয় যদি তিনি বিরোধী দলের হন। আরও আছে নারীবিদ্বেষ। হত্যাকাণ্ড ঘটলে পুলিশ থেকে শুরু করে অনেকেই খুঁজতে থাকে কোনো নারী জড়িত কি না। সেটি পেলেই সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বরগুনার আয়েশা সিদ্দিকার বেলাতেও তেমন আশঙ্কাই জাগে। অতি দ্রুত মূল হত্যাকারী ও তাদের নির্দেশদাতা বলে যাদের প্রতি অভিযোগ, তাদের ছেড়ে আলোচনা–নিন্দা সব ধাবিত হয় নিহতের স্ত্রীর দিকে।

এমন পরিবেশে নারী-সংশ্লিষ্টতা পাওয়ামাত্র আর কষ্ট করতে হয় না কাউকে। যা খুশি তা অনুমান করা যায়, বলা যায়। সেটি নিয়ে আরও দৌড়াতে শুরু করে একশ্রেণির গণমাধ্যম। এভাবে হত্যাকাণ্ডের মূল আসামিদের থেকে আমাদের মনোযোগ দূরে সরে যায়। অনেকের মন তখন সেই নারীর ‘চরিত্র’ ঘাঁটাঘাঁটি করতে ব্যস্ত থাকে। এভাবে জনমতকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আড়াল করতে পারেন মূল অপরাধীরা।

এই ধরনের চর্চা বরাবরই হয়, তবে তখনই আরও প্রকটভাবে সামনে আসে, যখন বরগুনার হত্যাকাণ্ডের মতো অনেক হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে ক্ষমতাসীন কেউ যুক্ত থাকেন। রিফাত হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের যোগসূত্রতা প্রথম থেকেই স্পষ্ট ছিল। শহরে দিনেদুপুরে এই রকম প্রকাশ্য খুনের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ প্রশাসন প্রথমে নিশ্চুপ ছিল। ঘটনাটি মিডিয়া ও জনগণের নজরে আসে যখন কেউ একজন সেই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আপলোড করেন। এরপর জনমতের চাপে পুলিশ সক্রিয় হয়। কয়েকদিনের মধ্যে ঘটনার অন্যতম আসামি নয়ন বন্ড কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তারপর গ্রেপ্তার করা হয় ঘটনার সাক্ষী এবং রিফাতের স্ত্রী আয়েশাকে। এই মামলায় ক্ষমতা আরও তেজদীপ্ত হয়ে ওঠে যখন আয়েশার পক্ষে স্থানীয় কোনো আইনজীবী কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেন। শেষে নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে আয়েশা সিদ্দিকার পক্ষে লড়াই চালানোর জন্য এগিয়ে আসেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না। পুলিশের রিমান্ড শেষে আয়েশা জামিন পেয়েছেন, তবে সেটিও শর্ত সাপেক্ষে। সেগুলোর মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো তিনি মিডিয়ার সামনে কথা বলতে পারবেন না।

রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তাঁর স্ত্রীসহ ২৪ জনকে আসামি করে ১ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ। মামলায় স্থানীয় সাংসদপুত্র সুনাম দেবনাথকে আসামি না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন আসামি। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, আদালত চত্বরে রাখা প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময় মামলার এক নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী, তাঁর ভাই রিশান ফরাজীসহ অন্য আসামিরা চিৎকার করে রিফাত হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে সুনাম দেবনাথের নাম বলেন। এমনকি প্রিজন ভ্যানে তোলার পরও আসামিরা চিৎকার করে সুনামের কথা বলে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁরা বলেন, ‘এটা অন্যায়, এটা অবিচার। সুনাম দেবনাথ কেন আসামি নাই, সুনাম দেবনাথ হত্যার নির্দেশদাতা, সে কেন আসামি নাই, এটা অবিচার, এটা অন্যায়।’

সাধারণ হিসেবে আমরা জানি, আসামিদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত যে–কাউকে পুলিশের গ্রেপ্তার করার কথা। মামলায় আসামি হিসেবে হাজির করার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। সবাই যখন আসামিদের চিৎকার শুনেছে এবং সুনামের নাম শুনেছে, তখন তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার পর থেকেই নানা কারণে এবং এই ঘটনায় সম্পৃক্ত ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাংসদপুত্র সুনাম আলোচনায় আসেন। কিন্তু এই মামলার তদন্তের সঙ্গে জড়িত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদকালে বা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার সময় সন্দেহভাজনদের কেউই সুনামের নাম উল্লেখ করেননি। তদন্তকারীরা আরও জানান, বরগুনার রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে সংগঠিত এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে সুনামের জড়িত থাকার প্রমাণও তাঁরা পাননি (দ্য ডেইলি স্টার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)।

শুধু সুনামের ক্ষেত্রেই নয়, আমরা দেখেছি ইয়াবা ব্যবসায়ী বদির ক্ষেত্রেও। অনেক সময়ই ক্ষমতাসীনেরা বিচারের আওতায় আসেন না। আর এই কারণেই ক্ষমতাহীনেরা ন্যায়বিচার পান না। এই ধরনের ক্ষমতা তোয়াজের সংস্কৃতি অন্য ক্ষমতাবানদেরও অপরাধে আগ্রহ ও উসকানি তৈরি করতে পারে। কারণ তাঁরা জেনে গেছেন, এই রাষ্ট্রে, এই সমাজে তাঁরা নানা ধরনের অপরাধ, খুন ও সন্ত্রাস করেও পার পেয়ে যাবেন। আমরা বলতেই থাকব, আমরা কিছুই দেখিনি, আমরা কিছুই শুনিনি?

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]