বিদায় ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন: শেষের শুরু, শুরুর শেষ

বিশ্বব্যবস্থাতত্ত্বের জনক সমাজবিজ্ঞানী ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন ছিলেন বিশ্ব পুঁজিবাদের এক আপসহীন সমালোচক। ছবি: ইমানুয়েল ভালেরস্টাইনের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।
বিশ্বব্যবস্থাতত্ত্বের জনক সমাজবিজ্ঞানী ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন ছিলেন বিশ্ব পুঁজিবাদের এক আপসহীন সমালোচক। ছবি: ইমানুয়েল ভালেরস্টাইনের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।

ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন সমকালীন বিষয় নিয়ে প্রতি মাসের এক আর ১৫ তারিখ ভাষ্য লিখতেন। ১৯৯৮ সালের অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে এ বছর জুলাই মাসের এক তারিখ পর্যন্ত তাতে কখনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। শেষ লেখাটির নাম দিয়েছিলেন “This is the end; this is the beginning”, ভবিষ্যতদ্রষ্টার মত বলেছিলেন, ‘এই লেখাটি আমার ৫০০তম ভাষ্য। এই হবে আমার সর্বশেষ ভাষ্য।’ তিনি গত হয়েছেন ৩১ আগস্ট।

ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন খুব পরিচিত নন আমাদের কাছে। তবে তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিমা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশাল আলোড়ন উঠেছিল; যদিও তথাকথিত প্রধান প্রচারমাধ্যমগুলো বিস্ময়কর রকম নীরব ছিল। এর কারণও আছে।

ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন সমকালীন সমাজবিজ্ঞানের একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব। বর্তমান আমলে সামাজিক আর মানবিক ন্যায্যতার জন্য সব সামাজিক আন্দোলনের তিনি ছিলেন এক নির্ভরযোগ্য মিত্র। মেক্সিকোর জাপাতিস্তা, কুর্দি মুক্তিসংগ্রাম, বিকল্প বিশ্বায়নের আন্দোলনকারীরা তাঁকে নিজেদের আপন বলে মনে করত। মৃত্যুকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ স্কলার ছিলেন। একাডেমিক জগতের বাইরে বিশ্ব পুঁজিতন্ত্রের পর্যালোচনায় তাঁর নাম আসে নোয়াম চমস্কির মতো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে এককাতারে।

২১ শতাব্দীর শুরু থেকে বিশ্বায়নের ধারণা সবার জীবনে প্রভাব ফেলেছে। আজকের কালের এক নতুন ঘটনা বলেও একে নিয়ে প্রচারণা হয়েছে। এসব নিয়ে যাঁরা ভাবনাচিন্তা করেন, তাঁরা সবাই অবশ্য এ নিয়ে একমত নন। কেউ বলছেন, এই ব্যাপার আগেও ছিল। আগেই চালু এক তত্ত্ব আর ধারণাকেই নতুন বলে চালানো হচ্ছে। যাঁরা বিশ্বায়নকে নতুন কিছু বলে মানেন না, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন।

যে অখণ্ড মনোযোগ নিয়ে তিনি সারা জীবন কাজ করে গেছেন, তা সুলভ নয়। বিশেষ করে সব বিরোধিতাই যখন উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়। ছিলেন সংগ্রামী, তত্ত্ব আলোচনা আর সত্য অনুসন্ধানে খুঁতবিহীন। আর মানুষ হিসেবে দিলখোলা। ইমানুয়েল ভালেরস্টেইনের জীবন আর কাজ একাডেমিতে আটক রাখতে চাননি। তাঁর জীবন ছিল বিশ্বজোড়া গণমানুষের বুদ্ধিজীবী হওয়ার দিকে পথচলা। সারা জীবন তিনি বিকল্প দুনিয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তার চেয়ে বেশি বলেছেন এই দুনিয়া হাতে গোনা কয়েকজন ‘গ্লোবাল এলিট’–এর স্বার্থের শিকার হয়ে ভুগতে পারে না সেই কথা।

প্রথম দিকে তাঁর কাজের বিষয় ছিল উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর গতি–প্রকৃতি। শিগগিরই তাঁর ভাবনা দুটি দিকে শাখা মেলে। ১৯৭০–এর দিকে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে তিনি আলোচনা শুরু করেন। সে ছিল বিশ্বায়নের আলোচনার নতুন একধারার পথপ্রদর্শক। ক্রমে সে আলোচনা পত্রপল্লবে বিকশিত হয়। সেই সূত্র ধরে দুনিয়া চালানোর ভাবতাত্ত্বিক ধরনগুলোর পর্যালোচনা শুরু করেন। সেই পর্যালোচনার মূল লক্ষ্য ছিল নয়া-উদারতাবাদী দাপটের পর্যালোচনা।

সমাজ নিয়ে ভাবনা তত দিনে পণ্ডিতি ফলানোর জায়গা হয়েছে। একাডেমির বাইরে এর যেন আর কোনো কাজ নেই। ভালেরস্টেইন একাডেমির ভেতর থেকে দুর্দান্ত প্রস্তাব করলেন—সমাজবিজ্ঞানকে একই সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক আর সংগ্রামী হতে হবে।

সমাজতাত্ত্বিক হিসেবে তিনি দুনিয়া কেমন করে চলে, তা বুঝেছেন তত্ত্ব ধরে। কিন্তু বাস্তব জীবন কি আদৌ তত্ত্বের ধার ধারে? ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন তাই দুনিয়া চলার ইতিহাস অধ্যয়ন শুরু করলেন। ১৫০০ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাসের পাঠ তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন দুনিয়াকে বদলানোর সংগ্রামের ধারাবাহিকতার প্রসঙ্গ ধরে। ছয় খণ্ডে সেই কাজ শেষ হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। চারটি বিশাল খণ্ডের পর আর এগোনোর সময় পেলেন না।

ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে আজকে আর দুনিয়াতে আলাদা আলাদা ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। বিশ্ব এখন একটা একক ব্যবস্থার অধীন। সেই বিশ্বব্যবস্থা মুনাফায় আসক্ত কেন্দ্রের দাপট দিয়ে শাসিত হয়। সেই কেন্দ্র জড়িয়ে আছে দুনিয়াজুড়ে ছড়ানো প্রান্ত আর আধা প্রান্তের সঙ্গে। অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক সম্পর্ক দিয়ে এই কেন্দ্র বাকিদের নিয়ন্ত্রণ করে। ভালেরস্টেইন ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামের কোনো ধারণা মানতেন না। তাঁর দাবি, দুনিয়াতে আসলে একটাই ব্যবস্থা চালু আছে।

এই বিশ্ব অর্থনীতি বা বিশ্বব্যবস্থা পুঁজি আর শ্রম আর সেই সঙ্গে মুষ্টিমেয় হাতে পুঁজির জমা হওয়ার টানাপোড়েনের মধ্যে চালু থাকে। একে নিজের প্রয়োজনে নিজের মতো করে টেনে নিয়ে যায় পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এমনকি এই যে ভিন্ন ভিন্ন জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র, সেগুলোও এই ব্যবস্থারই কলকবজা মাত্র। এই যে দুনিয়াজোড়া আলাদা আলাদা দুর্বল, সবল বা দাপুটে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখা যায়, সেগুলো আলাদা কিছু নয়। সেই একক ব্যবস্থার প্রয়োজনেই কাউকে দুর্বল কাউকে সবল করে রাখা হয়। এই ব্যবস্থা পৃথিবীকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। নিজেকে সে ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় হাজির করে ধোঁকা দেয়। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ের নাটকে এই ব্যবস্থার হাতে আসলে যারা চাপা পড়ে আছে, তাদের লড়াই দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যায়।

কালে কালে সেই ব্যবধান বেড়েছে। ফলে, এখন আঞ্চলিক হয়ে ভাবার আর কোনো অবকাশ নেই। ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন নিশ্চিত ছিলেন, কোনো না কোনো দিন এই পুঁজি আর মুনাফাসর্বস্ব বিশ্বব্যবস্থা বদলে যাবেই। পুঁজির মুনাফার হার যে দিন দিন কমে যাচ্ছে, বিশ্ব পুঁজিতন্ত্র যে একের পর এক সংকটে পড়ছে, এগুলো ছিল তাঁর আগ্রহের জায়গা। এর জন্য অবশ্য একাডেমেশিয়ানরা তাঁর সমালোচনা করেছেন; তিনি নাকি সংস্কৃতির চেয়ে অর্থনীতির ওপর খুব বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।

দুনিয়া নিয়ে মানুষের চিন্তা কোন পথ ধরে চলছে, কী বদল তাতে আসছে, কোন চিন্তা কেমন করে দাপুটে হয়ে উঠছে, সেই বিষয়ে ইমানুয়েল ভালেরস্টেইনের আগ্রহ কোনো দিন কমেনি। শুধু নিজের বিষয় নিয়ে জেনে বিশেষজ্ঞ হতে হবে—এমন কথা তিনি হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিতেন। দুনিয়ার গঠন বুঝলে কেবল হবে না। বহাল দুনিয়ার ঘাটতি বুঝে একে বদলানোর কারবারও বুঝতে হবে। এর জন্য তিনি বলতেন চিন্তকদের কাজ হচ্ছে ‘ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞান’ তৈরি করা।

কারখানার পণ্য তৈরির প্রক্রিয়া বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়েছে। সেই সঙ্গে জ্ঞান আর ভাবনার জগৎও টুকরো হয়েছে। দর্শন আর বিজ্ঞানের এই পশ্চিমা বিভাজন অতিক্রম করে এদের আবার এক করার আন্দোলন চালিয়ে গেছেন ইমানুয়েল ভালেরস্টেইন। এই যে দুনিয়াজুড়ে এখন চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম ইংরেজি, একে তিনি বলতেন ‘আলোচনার সূক্ষ্মতা গলা টিপে মারা’।

সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকার সম্ভাব্য সব সুযোগ তিনি কাজে লাগাতেন। যেখানেই কোনো খোলা বিতর্ক আলোচনা হবে, কোনো চালু বিষয় নিয়ে ব্লগে লেখা বা তর্ক হবে, ভালেরস্টেইন তার সবকিছুতেই জড়িয়ে থাকতে চাইতেন। প্যারিসের ঠান্ডা আবহাওয়ায় খুব ভোরে উঠে, দুপুরে একটা স্যান্ডউইচ খেয়ে মাঝরাত পর্যন্ত তিনি সব শ্রেণির মানুষের জন্য দ্বার খুলে রাখতেন। সবার কথা ছিল তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই নাম না–জানা সাধারণ মানুষগুলোর ভাবনাই জমাট বেঁধে একদিন বর্তমানকে পালটে দেয়।

জাভেদ হুসেন: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক