চালকের আসনেই আছে এডিস

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিশাকুণ্ডী ইউনিয়নের শ্যামনগর গ্রামের জোছনা খাতুন (৫৮) গত মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকার এক নামজাদা হাসপাতালে মারা যান। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর রাজধানীতে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন তিনি। তিন দিনও টিকলেন না। গত ৩০ আগস্ট শুক্রবার জোছনা খাতুনের ডেঙ্গু ধরা পড়ে। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসার পর তাঁর অবস্থার অবনতি হলে রোববার (১ সেপ্টেম্বর) তাঁকে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ৪ সেপ্টেম্বর বুধবার জোছনা খাতুনের দাফনের পরপর খবর আসে, রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ইসরা তাসকিন অস্মিতার (১৩) মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। ইসরা তাসকিনসহ তাদের পরিবারের মোট চারজন ডেঙ্গুতে ভুগছিল। তাদের মধ্যে ইসরার অবস্থার অবনতি হলে তাকে অন্য এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছয় দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর তার মৃত্যু হয়।

মধ্যে দু-এক দিন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে কম থাকলেও ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা আবার বেড়েছে (সূত্র: প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর অনলাইন)। ৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে ৪ সেপ্টেম্বর বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয় ৮২০ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৪৫ জন, ঢাকার বাইরে ৪৭৫ জন। ২ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল ৮টা থেকে ৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছিল ৭৮৩ জন। রোগীর সংখ্যা বাড়া-কমার মধ্যেই এখন থাকবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। হাসপাতালে এক দিন ভিড় কমলে আরেক দিন তা বাড়তে পারে, পরিস্থিতির উন্নতি দেখানোর জন্য পরিসংখ্যান নিয়ে খেলা করার নজির এ দেশে অনেক আছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় আত্মতুষ্টির ঢেকুর তোলার সময় যে এখনো আসেনি, সেই বার্তাই মফস্বলের জোছনা খাতুন আর রাজধানীর ইসরা পরিষ্কার আর জোর দিয়ে বলে গেল। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, ইসরার মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কক্ষের সংক্রমণে। যে গেছে বা যাঁর গেছে, তাঁর কাছে এই তর্ক বেহুদা বেশরম তর্ক। ক্ষতিপূরণের দায় নির্ধারণের আলোচনায় কাউকে ছাড় দিতে বা কাউকে ধরতে এসব বাগ্‌বিতণ্ডা দরজার খিল আটকিয়ে যে কেউ করতে পারেন, তবে প্রকাশ্যে না করাই উত্তম। তাই ৫৭ জন মরেছে না ৩০০ জন মরেছে, সে তর্কে মানুষের কোনো ফায়দা নেই। এটাই এখন চরম সত্য যে ঢাকা শহরে বসবাস করে এমন কোনো পরিবার নেই যে ডেঙ্গু নিয়ে দুশ্চিন্তায় নেই। এমন কোনো পরিবার নেই, যাদের কোনো না কোনো পরিচিত, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি। তাই পরিসংখ্যান নিয়ে হইচই করার চেয়ে এখনকার সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ।

 এডিস মশা খুবই সার্থকতার সঙ্গে ইতিমধ্যেই ডেঙ্গুর বিষ রাজধানীর বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, শহুরে এডিস ইজিপটাই পল্লির ঝোপঝাড়ে থাকা তার জংলি ভাই-বেরাদর এডিস এলবোপিকটাসের কাছে ডেঙ্গুর জীবাণু হস্তান্তরে সক্ষম হয়েছে। এডিস এলবোপিকটাস একই ঘরানার মশা হলেও সে ঘরে নয়, ঝোপঝাড়ে থাকে, ঘরের বাইরে সে কামড়ায়। এ জন্য এটিকে এশিয়ান টাইগারও বলা হয়। ইজিপটাই ঘরের মশা ঘরের আশপাশে থাকতে পছন্দ করে, অন্যদিকে গাছের কোটরে, কলাগাছের দুটো পাতার মাঝখানে বা কচুগাছের দুটো পাতার মাঝখানে যে পানি জমে, বাঁশ কাটার পর সেখানে থেকে যাওয়া গোড়ায় যে পানি জমে, সেখানে এলবোপিকটাস মশা বেশি হয়। এককথায়, প্রাকৃতিক আধার সে ব্যবহার করে। দেশের কোন অঞ্চলে এই প্রজাতির মশার বসবাস বেশি, সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনো সবিস্তার অনুসন্ধান না হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা খুব বেশি কিছু বলতে পারছেন না। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক কবিরুল বাশার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘এডিস এলবোপিকটাস যেহেতু মহামারি আকারে রোগ ছড়াতে পারে, সেহেতু এডিস এলবোপিকটাসই রোগ ছড়াচ্ছে বলে আমরা ধারণা করছি। তবে এখনো এর গবেষণালব্ধ তথ্য আমাদের কাছে নেই। এলবোপিকটাস শুধু ডেঙ্গু নয়, ইয়েলো ফিভারের মতো রোগব্যাধি বিস্তারের ক্ষমতা রাখে।’

কুষ্টিয়া আর যশোরে ডেঙ্গুর আবির্ভাব, বিস্তার এবং স্থায়িত্ব এডিস এলবোপিকটাসের কেরামতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। জানা গেছে, ঈদুল আজহার পর থেকে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ছাতারপাড়া গ্রামে আশঙ্কাজনক হারে ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেউই ঢাকা প্রত্যাগত ছিল না। ছোট্ট এক গ্রামে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৪২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের খবর চাউর হওয়ার পর জেলা ও উপজেলা প্রশাসন জরুরি পদক্ষেপ নিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খায়। সপ্তাহখানেকের জোর চেষ্টার পর ছাতারপাড়া গ্রামের পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও দৌলতপুর উপজেলার ইউসুফপুর, কমালপুর, খলিশাকুণ্ডী ও মহিষকুণ্ডী প্রভৃতি এলাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় একই সময়ে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডেঙ্গু অনেকটা মহামারির রূপ নেয়। উপজেলার রোহিতা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে (রাজবাড়িয়া-এড়েন্দা) এক মাসে নারী-শিশুসহ অন্তত ৮৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়।

ওয়ার্ডের এড়েন্দা বিলপাড়ায় ৫২ জন, দক্ষিণ পাড়ায় ১৪ জন ও রাজবাড়িয়া গ্রামে ২০-২৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। অবশ্য সরকারি তথ্যমতে, এড়েন্দা গ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫২। ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপার দুটি গ্রামেও মাত্র সপ্তাখানেক সময়েই কমপক্ষে ৩৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন এলাকাবাসী। বরিশাল অঞ্চলে ডেঙ্গু আক্রান্তের কোনো ইতিহাস না থাকলেও এ বছর এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৯০০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারাও গেছে বেশ কয়েকজন। এদিকে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার খবর আক্রান্ত এলাকার মানুষকে আরও সন্ত্রস্ত করে তুলছে। গত ২৮ আগস্ট ‘ছোট্ট গ্রামে ডেঙ্গুর বড় আক্রমণ’ নামে কুষ্টিয়ার ঘটনা প্রথম আলোতে ছাপা হলে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) চার সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল সেখানে পাঠায়। বিশেষজ্ঞরা কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ডেঙ্গুকবলিত দৌলতপুরের ছাতারপাড়ায় নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় ফিরেছেন, এখন অপেক্ষা ফলাফলের। ইজিপটাই না এলবোপিকটাস—কে এখন রাজ করবে, সেটা আঁচ করা যাবে এই অনুসন্ধান থেকে।

এডিসের দুই প্রজাতির মোকাবিলায় আমাদের দুই ধরনের কৌশল নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, শহর-নগর থেকে এডিস ইজিপটাই যত সহজে বশে আনা যাবে, পল্লিগ্রামের এডিস এলবোপিকটাসকে তত সহজে কবজা করা যাবে না। প্রকৃতির কোলে থাকা এই মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের প্রকৃতির সহায়তা নিতে হবে। ঝোপ-জঙ্গলের মশার মূল খাদক হচ্ছে ব্যাঙ, বাদুড়, চামচিকা। জঙ্গলে এদের বিচরণ যাতে বাড়ে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এডিস এলবোপিকটাসকে কীটনাশক দিয়ে জব্দ করতে গেলে প্রকৃতিতে থাকা আমাদের বন্ধু কীটপতঙ্গের (মৌমাছি, প্রজাপতি ইত্যাদি) শেষ ঘণ্টা বেজে যাবে। আমাদের সব প্রচেষ্টা সার্থক আর প্রকৃতিবান্ধব হোক।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]