লজ্জার মৃত্যু ও উগান্ডান আদর্শ

সব পর্দা আড়াল করে না। সব বালিশ হালকা না। আড়ালের বদলে কোনো কোনো পর্দা দুর্নীতির গুমর ফাঁস করে। কোনো কোনো বালিশ প্রকাশ করে লুটপাটের বিপুল ভার। কোথাও কোনো লজ্জা নেই। আমরা আকছার দুর্নীতি করে গিয়ে বলি, সরল বিশ্বাসে করেছি। কারণ, আমরা জেনে গেছি, ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে ‘সরল বিশ্বাসের’ দোহাই দেওয়া আছে। আমরা নির্মল বায়ু প্রকল্পে গুচ্ছ গুচ্ছ কর্মকর্তাকে বিদেশে ঘুরতে পাঠাই।

রাজধানীর দুই মেয়রই এখন বিদেশে। দক্ষিণের মেয়র গেছেন মশকনিধন শিখতে। কোথায় আবার, সিঙ্গাপুরে। অন্য মেয়র ইউরোপে মেয়রদের সম্মেলনে চলে গেছেন হুইলচেয়ারে বসে। যাত্রার আগের দিন কোনো কারণে পায়ে ব্যথা পাওয়ায় তাঁকে এই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তবু বিদেশে তো যেতে হবেই, যা কিছু ভালো তা তো সব বিদেশেই।

এমনকি যে উগান্ডা নিরাপদ পানি প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের চেয়ে দুর্দশায়, সেখানেও আমাদের পানির উন্নয়ন জানতে যাওয়া চাই। তাই নিরাপদ পানি প্রকল্পের খাতিরে ৪১ জন মিলে উগান্ডা দেশ ঘুরে আসি। বুঝলাম বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প, তারাই পাঠিয়েছে। গেলে যাবেন প্রকৌশলী-প্রশাসকেরা। অন্যদের সেখানে কী কাজ?

তাঁরা উগান্ডা সফর করে না এলে কি জানতে পারতাম, সেখানে নিরাপদ পানি পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের চেয়ে কম হলেও অন্য জিনিস ভালো? সেখানকার ওয়াসা যত্রতত্র সড়ক খুঁড়ে হাঁ করে রাখে না, রাস্তাঘাটও পরিষ্কার। এতেও যে আমাদের কর্তাদের বোধোদয় হবে, সে ভরসা কম। কারণ আর কিছু না, উগান্ডান কর্মকর্তাদের যা আছে, তা আমাদের নেই। সেই বস্তুর নাম হলো লজ্জা।

লজ্জাই নাকি সভ্যতা। লজ্জা ছাড়া মানুষ হিংস্র হতে পারে, বর্বর হতে পারে, অমানবিক হতে পারে। মানুষ নিজেও তা জানে। জানে মনের ভেতরের গোপন সব বাসনা ও প্ররোচনা তাকে কীভাবে লজ্জার কথা ভেবে সামলাতে হয়। সেই হিংস্রতা ও বর্বরতা সামাল দিতে তাই নৈতিকতা এসেছে, আইন এসেছে। সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে মানুষ। এসবের চাপে মানুষ নিজেকে সভ্য করে তুলেছে। বলা যায়, যতটা সভ্যতা ততটাই মানবিক হয়েছে তারা। যিনি অকাতরে মিথ্যা বলে যান, আপন–পর সবাইকে ধোঁকা দেন; তিনি কখনো মানবিক হতে পারেন না। লজ্জার মাথা না খেলে কেউ দেশ ও জাতির মাথা খাওয়ার চেষ্টা করতে পারে না।

বড়পুকুরিয়ার কয়লার পাহাড় থেকে শুরু করে বগুড়ায় সারের গোডাউন ভোজভাজির কায়দায় গায়েব হয়ে গেলেও কিছু হয় না। প্লাবনের মতো দুর্নীতি, তবু এক মন্ত্রী বললেন, এগুলো নাকি ছোট ব্যাপার। এসবই লজ্জার মৃত্যুর লক্ষণ। সাবেক এক অর্থমন্ত্রী হাজার কোটি টাকার ব্যাংক লোপাটকে মামুলি ব্যাপার বলে মনে শুধু করতেনই না, সাংবাদিকদের সামনে তা বলতেনও। তিনিই আবার অনিয়মের পথে শুল্কমুক্ত গাড়ির আবদার করে বসেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও ডিন চিরকুট দিয়ে অবৈধভাবে ছাত্র ভর্তি করাচ্ছেন। আবার তিনিই দিবারাত্র নীতি–নৈতিকতার কথা প্রচার করে যাচ্ছেন। যে সাংসদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি, তিনি সবক দিচ্ছেন গণতন্ত্রের।

লজ্জা গণতন্ত্রেরও শর্ত। জিল লক নামের এক আমেরিকান ভদ্রলোক Democracy and the Death of Shame (গণতন্ত্র ও লজ্জার মৃত্যু) নামে বই লিখেছেন। সমাজ থেকে লজ্জা উঠে গেছে বলে যখন মানুষ আহাজারি করে, তখন বুঝতে হবে যে জনতা অসন্তুষ্ট। মানুষ অনেক অপকর্ম করে না লজ্জার ভয়ে। আমরা জামাকাপড় পরা থেকে শুরু করে ভদ্রতা–শিষ্টতা চালিয়ে যাই লজ্জাবোধের জন্য। দুর্নীতি, অপরাধ, অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকে মানুষ যদি লজ্জা–ফ্যাক্টর কাজ করে মনে। এসব প্রকাশ পেলে লোকে কী বলবে, কেমন করে মানুষের সামনে দাঁড়াব, কেমন করে ছেলে–মেয়ে, মা–বাবা, স্ত্রী–স্বামীর মুখোমুখি হব—এসব চিন্তা যার মাথায় কাজ করে, তার পক্ষে লজ্জাকর কাজ করা কঠিন।

জনগণের ধিক্কারের ভয়ে রাজনীতিবিদেরা অনেক কিছু করেন না, করলেও চূড়ান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করেন। কিন্তু ট্রাম্পের মতো ভদ্রলোকের মুখে অনেক কথা আটকায় না দেখে বোঝা যায়, লজ্জাহীনেরা ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে পারে আজকাল। পুরোনো প্রেমিকাকে তিনি ঘোড়ামুখো বলতে দ্বিধা করেন না। হরদম মিথ্যা বলেন, সকালের কথা বিকেলে অস্বীকার করেন। লজ্জা নামক জরুরি মানবিক বৈশিষ্ট্যটি না থাকায় এটা নিয়ে তাঁকে তেমন বেগ পেতে হয় না।

পশুপাখি মানুষের সামনে কোনো কিছু করতে লজ্জা পায় না। মানুষও পশুপাখিকে লজ্জা পেয়ে কোনো কিছু করা থেকে বিরত থেকেছে বলে শোনা যায় না। এ বিষয়ে মনে হয় গবেষণা করতে হতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনে বিদেশেও যাওয়া লাগতে পারে যে, বাংলাদেশের শাসক–প্রশাসকেরা জনগণকে পশুপাখির স্তরে বলে মনে করেন কি না। সতেরো কোটি মানুষকে যদি তাঁরা মানুষ মনে করতেন, তাহলে অন্তত লজ্জা পেতেন।

ভয় হয়, ওপরতলার দেখাদেখি সমাজটাই নির্লজ্জ হয়ে ওঠে কি না। ভাবুন তো, কাল থেকে লজ্জা নামক জিনিসটা কোনো গায়েবি কারণে চলে গেল, চোখের পর্দা উঠে গেল! অবস্থাটা কল্পনা করুন আর ভাবুন প্রকৃতির সবচেয়ে হিংস্র ও লোভী প্রাণী মানুষ সে অবস্থায় কী কী করতে পারে! এবং তার কী কী আলামত ইতিমধ্যে আমাদের চারপাশে দেখা দিচ্ছে?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]